তৃতীয়ঃ
“বলি ও হরিরামের খুড়ো,
তুই মরবি রে মরবি বুড়ো;
সর্দি-কাশি হলদি জ্বর,
ভুগবি কত জলদি মর…”
পারভেজ স্যারের কাছে কষে কানমলা খেতে খেতে এই লাইনগুলো “টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার”-র সুরে মনে মনে গাইছিল বেদ। বেদের ভালো নাম বেদব্রত বসু।
পারভেজ স্যার বেদের স্কুলের হেডমাস্টারমশাই। ওনার কানমলা মহকুমায় বিখ্যাত। বাবা বলেন, পারভেজ স্যারের কানমলা খায়নি এরকম ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার উকিল এমনকি পুলিশ পর্যন্ত জেলায় নাকি খুব কম। এই তো বেদের দাদা এবছর ইঞ্জিনিয়ারিঙের প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়ার একদিন আগে বাবা টানতে টানতে নিয়ে গেলেন পারভেজ স্যারের বাড়ি। দাদা যখন সন্ধ্যের পর বাবার হাত ধরে ফিরল, তখন মুখটা লাল, কানটা বেগুনি। বাবা হাসতে হাসতে বললেন, “যাক, আর চিন্তা নেই। এবার তোমার ছেলে পাশ করল বলে।” সেই আনন্দে রাতে লুচি-ছোলার ডাল করা হল। দাদা পরের দিন অম্বলের ওষুধ গিলে কোনোরকমে ঢেঁকুর চাপতে চাপতে পরীক্ষা দিয়ে এল।
এহেন পারভেজ স্যার এখন বেদের কান নিয়ে সেটাকে প্রথমে চাবি, তারপর গামছা, এখন পাতিলেবু চিপে রস বের করার মত করে টিপে ধরে আছেন।
“প্রেমপত্র? আমার ছাত্র হয়ে প্রেমপত্র লিখেছ তুমি? আর এটা কি বানান? ‘শরস্বতি পুজ’ ? এই বিদ্যে নিয়ে তুমি…?” রাগে কাঁপতে কাঁপতে স্যার ঠকাস ঠকাস করে পেপারওয়েটটা ঠুকতে থাকেন টেবিলে।
“ছি! ছি! ছি! ছি!... ছিঃ! এটা একটা বয়েস হল প্রেমপত্র লেখার? আরে তোর বাবা আমায় সেদিন আলুর দোকানে দেখেও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল; তোর দাদা দুদিন পর ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশের মহকুমার স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। তার ভাই কি করছে? না অল্পবয়সে গাঁ…” কি একটা বলতে গিয়ে চুপ করলেন স্যার।
সেই ফাঁকে বেদ ভাবতে লাগল, ইশ এটা তো বাবা আজ জানবেই। তারপর পাড়ার শেয়াল কুকুর কাঁদবে তার দুঃখে। আর মা? সব শেষে মা একটা হাঁড়ির মত মুখ করে বলবেন, “যতদিন না এগুলো করা বন্ধ করছ আমায় মা বলে ডাকবে না।” বাবার ওই সাতচোরের মার আর মায়ের ওই একটা কথা যেন সমান সমান।
আচ্ছা দোষটা কি ছিল বেদের? একটা চিঠিই তো লিখেছিল। বানানগুলো একটু এদিক ওদিক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এরকম অনেক ভুল বানান ছেলেবেলা, জীবনস্মৃতি আর গীতবিতানেও আছে। বাংলার স্যার কিংশুকবাবুকে কথাটা জিগ্যেসও করেছিল বেদ। ওই একটি লোককেই একটু ঠিকঠাক মনে হয় বেদের। বাদবাকি স্যাররা তো নিমের পাঁচন। বিছুটির আচার। শুঁয়োপোকার রোঁয়া। কিংশুকবাবু বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের বানান নাকি মোটেই ভুল নয়। অভিধান মাঝে মাঝে একটু এদিক ওদিক হয়, তখন তাদের সংশোধন করাতে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বানান একেবারে অব্যর্থ। পরের কথাটা আগে বোঝে নি বেদ।
“রবি ঠাকুরের গান, কবিতা, লেখা এসব চোখ দিয়ে পড়ে মুখস্থ করে পরীক্ষায় লেখবার জন্য নয় কেবল। উপলব্ধি করার জন্য, বোঝার জন্য। মন দিয়ে পড়ার জন্য।” ফার্স্ট বেঞ্চে বসে অনিরুদ্ধ আর ইফতেকার খুব মাথা নাড়ছিল তখন। বেদের পেন্সিলবক্সে একটা পাখির পালক লোকানোর দরকার ছিল বলে সেই মুহূর্তে কথাটা মাথায় তেমন ঢোকে নি তার। ঢুকল, তবে পরের দিন প্রেয়ারে।
ইলেভেনে পড়ে তৃণাদি। স্কুলের ক্যাপ্টেন। যেমনি পড়ায় তেমনি আঁকায়, তেমনি ভালো নাচে। ইলেভনের ইংলিশের টিচার নলিনীবালা মিস। আড়ালে সবাই ব্জ্রবালা বলে। ব্জ্রবালা মিসকে নাকি শেষ হাসতে দেখা গিয়েছিল নারায়ণদা স্কুলের গাছ থেকে সুপুরি পাড়তে গিয়ে পড়ে যাওয়ার সময়। তখন বেদের দাদারা সিক্সে পড়ত। তারপর ব্জ্রবালা মিস হেসেছেন এই চারমাস আগে ইন্টারস্কুল ডিবেট কম্পিটিশানে তৃণাদি জেতার পর। পারভেজ স্যার একমাত্র তৃণাদিকে অনুমতি দিয়ে রেখেছেন শরীর খারাপ লাগলে বাড়ি যাবার; বাকিদের হলঘরে হেড ডাউন করে বসে থাকতে হয়।
সেদিন তৃণাদি প্রেয়ারে এসে গম্ভীর হয়ে গীতবিতান খুলে গান গাইতে শুরু করল।
“বিশ্বসাথে যোগে যেথায়…”
নিয়ম হল স্কুল ক্যাপ্টেন এক লাইন গাইবে, সেটা শুনে বাকিরা সেই লাইনটা গাইবে। গানটার আগামাথা মোটে বোঝে না বেদ। তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল “আনন্দ সেই আমারও…”-র জায়গাটা। কারণ তারপর গানটা শেষ হয়ে যায়। আজ গাইতে গাইতে মন দিয়ে শুনল কথাগুলো বেদ।
“গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মত ছড়িয়ে পড়ে…”
বেদ লাইনটা শুনে পরের লাইনগুলো আর গাইলই না। এমনকি তার প্রিয় জায়গাটাও না।
একবার “ইউরেকা!!” বলে চেঁচাতে ইচ্ছে হল তার। এই তো! এইটেই তো এই কয়মাস ধরে ভাবছিল বেদ। হয় তো একটা কিছু বটেই তার, কিন্তু সেটাকে ঠিক কি ভাবে বলা যায় ভেবেই পাচ্ছিল না। টিফিনের সময় সজলকে টেনে এনে মাঠে বসল বেদ। সজল তার প্রাণের সখা, দুনিয়ার যত কুকর্মের সাথি। এক হাতে রুটির মধ্যে তরকারি ভরে রোল করে খেতে খেতে কাকের বাসা দেখছিল সজল। বেদ তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তৃণাদির প্রেমে পড়েছি।”
সজল আরেকটু হলে রুটিটা ফেলে দিত। কোনোরকমে ধরে ফেললেও ভেতর থেকে আলুগুলো পড়ে গেল।
“কি বললি? কার কিসে পড়েছিস?”
“তৃণাদির। প্রেমে।”
“এটা যদি ননভেজ বা ব্জ্রবালার কানে যায় তাহলে পতাকার সাথে তোকেও টাঙিয়ে দেবে। আর তার নিচে আমরা কাল থেকে প্রেয়ার করব।”
বেদ চুপ করে বসে ঘাস ছিঁড়তে লাগল; কথাটা যে একবার তারও মনে হয় নি তা না। পারভেজ স্যার যদি থাকতেন তাহলে বোধহয় রবি ঠাকুরেরও নোবেল পাওয়া হত না। বানানভুলের জন্য নির্ঘাত গীতাঞ্জলীর কবিতাগুলো কেটে দিতেন স্যার।
ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে জায়গাটা প্রায় সাদা করে ফেলল বেদ। সজল ওদিকে বলেই যাচ্ছে, “তারপর ইলেভেনে অজুদা আছে, মানে তোকে ফুটবলের সময় লোহার বুট পরে নামতে হবে। সাকেত ভাইয়া আছে। সাকেত ভাইয়া আবার আমার সাথে একই বাসে যায়। আর যদি সৌরভদা জানতে পারে?”
এবার বেদের সত্যি ভয় করল। সৌরভদা পরশু তার ব্যাটটা নিয়ে গেছে সামনের সপ্তাহে ম্যাচ আছে বলে। প্র্যাকটিস করবে। কার ম্যাচ, কার সাথে, কোথায় কিছুই বেদ জিগ্যেস করার কথা ভাবতেই পারে নি। ওরে বাবা! সৌরভদা শান্ত থাকলে ফ্রিজের জল, রেগে গেলে দুর্যোধন হয়ে যায়। সজলের হাতদুটো ধরে বেদ বলল , “ভাই কিছু কর। অন্তত একটা আইডিয়া দে।”
“কিসের আইডিয়া দেব তোকে? পুরো স্কুল ছেড়ে তুই পড়লি কার? না তৃ…”
“নাম বলিস না! সাকেত ভাইয়া…!”
সজল ঘাসে পড়ে থাকা আলুর দম গুলো দেখতে দেখতে বলল, “উফ মা যা আলুর দমটা করেছিল রে! তোর জন্য পড়ে গেল। এবার তার সাথে আমিও পড়ে মরি আর কি! শোন ভাই, ভালো কথা বলছি, ঝামেলা পাকাস না। এই রবিবার চাঁদুদের মাঠে খেলা আছে, তোর কিছু হয়ে গেলে আগেরবারের মত সাত-আটটা ভরে দেবে।”
“সজল! ভাই! বুঝছিস না…খালি একটা আইডিয়া দে যে বলব কি করে। আর মার যেন না খাই।”
“হমমমমমমমম…” এবার সজল ভাবতে শুরু করেছে। বেদের প্রাণে একটা হালকা স্বস্তি এল। সজল ভাবলে সাধারণতঃ একটা উপায় বেরয়।
“তৃণাদি জানে না তো?”
“কিচ্ছু জানে না।”
“ভাই, জানতে পারলে কিন্তু বিপদ হয়ে যাবে।”
“দেখ! প্রেমে পড়েছি তো পড়েছি। এখন পিছিয়ে আসা যায় না।”
সজল আবার ভাবতে শুরু করে।
“ওকে। শোন তোর সবুজ বলটা আমায় দিবি, আর যাওয়ার সময় তোর সাইকেলটা আমি চালাব।”
সবুজ-হলুদ-গোলাপি, পারলে বেদ সোনার বল এনে দেয়। কিন্তু সাইকেল? জীবনে একবারই অঙ্কে ১০০ পেয়েছে সে গতবার ক্লাসে উঠতে। বাবা ভালোবেসে কিনে দিয়েছেন। সাইকেলটা বেদের এত প্রিয় যে এবার হাফ ইয়ারলিতে অঙ্কে ৭ পাবার পর বাধ্য হয়ে সেটা ৭৯ করতে হয়েছে; নাহলে নির্ঘাত বাবা টিন-আর-লোহা-ভাঙা-বিক্রিওয়ালা ডেকে সাইকেলটা বেচে দেবেন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচানো সাইকেলে কি না সজল? বেজার মুখ করে বেদ বলল , “বল কি করতে হবে?”
“চিঠি লেখ। লাভ লেটার।”
তাই তো! এই কথাটা মাথায় আসে নি কেন আগে? চিঠি লিখলেই তো বলতে সুবিধে। নাম জানাতেও হল না, আবার সব বলাও হয়ে গেল।
মাথা খাটিয়ে গল্পের বই থেকে লাইন দেখে ভুল বানানে চিঠিটা লিখেছিল ঠিকই বেদ, তবে তৃণাদির হাতে যেতে গিয়ে সেটা পারভেজ স্যারের টেবিলে চলে গেল। সজলেরই দোষ। তাদের ক্লাসে বেদ একমাত্র যে সাহস করে প্রেমপত্র লিখছে। তাও ইলেভেনের দিদিকে। তাও যে সে দিদি না, একেবারে স্কুল ক্যাপ্টেন! এতবড় খবরটা কি না বলে থাকা যায়? এর মুখ ওর মুখ করতে করতে গল্পের গরু শিং নাড়াতে নাড়াতে ঢুকে গেল হেডস্যারের ঘরে।
সন্ধ্যেবেলা বেদের বাবা অফিস থেকে ফিরে দেখলেন প্রতিবেশী অঞ্জনিপুত্র বাবু ও তাঁর ছেলে ঋজু দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। একটু অবাক করা ব্যাপার; কারণ পরশুই অঞ্জনিবাবুর সাথে পেয়ারা গাছের ডাল কাটা নিয়ে প্রায় মামলা হয়ে যাচ্ছিল। ঢুকতে ঢুকতে জিগ্যেস করলেন, “কি ব্যাপার? আপনারা?”
আকর্ণ হেসে অঞ্জনিপুত্র বললেন, “হে হে! আপনার সোনার চাঁদ ছেলে দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল করবে। সেই কথাই এতক্ষণ শুনছিলুম। পারভেজ স্যার নিজে এসেছেন কিনা আপনাদের এখানে।”
পারভেজ স্যার? কিন্তু বড়টার রেজাল্ট বেরতে দু’মাস দেরি। ছোটটার হাফ ইয়ারলির রেজাল্ট বেরল এই সেদিন। খারাপ করে নি তেমন। অঙ্কে এবার ১০০ পায়নি ঠিকই গেল বারের মত, তবে ৭৯ কম না। একটা গল্পের বই কিনেছেন ছেলেটার জন্য, ‘ছোটদের সচিত্র রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ’। মনে মনে ভেবেছেন ছেলেকে আদর করে বইদুটো দেবেন। বুঝিয়ে বলবেন ছাইপাঁশ না পড়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে। এর মধ্যে পারভেজ স্যারের আসার কথা তো ছিল না। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে পরিষ্কার শোনা গেল স্যারের গলা, “মা, তোমার বড় ছেলেটি কয়েকদিন পর স্কুল-মহকুমা-জেলার মুখ উজ্জ্বল করবে। তার ভাই হয়ে কিনা এরকম আচরণ ? তুমিই একটু বুঝিয়ে বল। আরে আমরা যখন ওর বয়সে ছিলাম তখন নেতাজির ডাকে সারা দেশ উত্তাল…” ইত্যাদি। সবটা শোনার পর বেদের বাবা ছাদ থেকে বাঁশ পাড়তে ছুটলেন। গোল্লায় গেছে রামকৃষ্ণ আর চুলোয় যাক বিবেকানন্দ!
আজ তিনি বেদকে শেখাবেন ‘Spare the rod, spoil the child’ ।
পরদিন সজল বেদের হাতে একটা বামের শিশি দিয়ে বলল, “সরি ভাই। মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে। এইনে! অবনী ঘোষের অরিজিনাল বিদ্যুৎ বাম। দিম্মার ড্রয়ার থেকে নিয়ে এসেছি। আজ থেকেই লাগা। মানে রবিবার চাঁদুদের মাঠে…”। হাতটা ঠিক থাকলে বেদ সজলকে সোজা চাঁদেই পাঠিয়ে দিত, কিন্তু বাবা কাল কনুইতে একটা এমন পেল্লাই গুঁতো মেরেছেন যে শুক্রবারের আগে হাত নাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। কোনোরকমে বামটা নিয়ে সে ডলতে শুরু করল।
“বেদ…”
“উঁ।”
“ভাই একটা কথা বল। চিঠিটা কোথায়?”
বেদ একটা কথাও বলল না। সজলকে আর বলা যাবে না এসব। চিঠিটা বেদ কায়দা করে বাড়ি যাওয়ার সময় স্যারের স্কুটারের পেছনে বসে ব্যাগ থেকে বের করে নিয়েছিল। ভাগ্যিস স্যার টের পাননি। নাহলে কপালে আরও দুর্ভোগ জুটত। বাড়ি গিয়ে পারভেজ স্যার কিছুতেই খুঁজে পেলেন না চিঠিটা। তারপর বেদের মা চা আর কচুরি নিয়ে আসায় চিঠি হারানোর প্রসঙ্গ ক্রমে চাপা পড়ে যায়। বেদ হাসে মনে মনে, হুঁ হুঁ বাবা । ‘জলপান’-এর কচুরি ডঃ বিধানচন্দ্র রায় নিজে এসে খেতেন। ছবি আছে দোকানে অনেক পুরনো একটা, আর ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের সই করা সার্টিফিকেট। পারভেজ স্যার তো সেখানে বগার আলুর চপেই গলে যান। চিঠিটা রয়ে গেছে বেদের স্কুলের ডায়েরির ভেতরে।
দুপুরে যখন তৃণাদিরা নাচের রিহার্সালের পর লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছে তখন বেদ চাঁপাগাছের নিচে একটা কাঠবাদাম খাওয়ার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ তৃণাদি দল থেকে আলাদা হয়ে তার দিকে এগিয়ে এল।
“এই তোর নাম বেদব্রত? এদিকে শোন।”
বেদ এক দৌড়ে স্কুলের দিকে যাওয়ার কথা ভাবছিল। কিন্তু তৃণাদি ডাকছে। দেখে রাগ করেছে বলেও মনে হচ্ছে না। একটা রিস্ক নেয়া যেতেই পারে মনে করে এগিয়ে গেল সে, পকেটে চিঠি আর কাঠবাদাম।
“তুই নাকি আমায় চিঠি লিখেছিস?”
বেদের কানটা লাল হয়ে গেল। ভগবান জানে কোন পাগল বাথরুমগুলো এত দূরে দূরে বানিয়েছে।
“চিঠিটা আমায় না দিয়ে পারভেজ স্যারকে দিতে গেলি কেন?”
“না মানে…আমি মানে…ওই সজল…”
“সজল কে? তুই বেদব্রত না সজল?” হাসতে থাকে তৃণাদি।
“না আমি বেদব্রতই”, প্রাণপণে মাথা নাড়ে বেদ, “সজল আমার…ইয়ে ক্লাস এইট…”
তৃণাদি একটু চুপ করে হাসি চেপে আবার বলে, “চিঠিটা কোথায়?”
বেদ কাঁপতে কাঁপতে বের করে দেয়। ভয়ে ভয়ে বলে, “প্লিজ দেখ তুমি কাউকে বল না। সৌরভদা আমার ব্যাট নিয়ে নিয়েছে আর অজুদা জানতে পারলে আমার খেলা বন্ধ করে দেবে। আর ননভেজ কাল আমাদের বাড়ি গিয়ে…”
“শরস্বতি বানান ভুল” বলে চিঠিটা ব্যাগে ভরে নেয় তৃণাদি, “এত বানান পরেরবার ভুল করলে আরও মার খাবি। যা…”
কিংশুক ব্যাগ থেকে খাতা বের করতে করতে পূর্বাকে ডাকল , “পূর্বা! চা!”
পূর্বা ততক্ষণে চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছে। কিংশুকের ভীষণ খারাপ অভ্যেস। রাতে খেয়ে উঠে যতক্ষণ খাতা দেখে ততক্ষণ চা করে দিতে হয়। সিগারেটটা পূর্বা অনেক বলে কয়ে কমিয়েছে, কিন্তু চায়ের নেশা দুজনেরই। ক্লাস টেন, ইলেভেন আর টুয়েলভ, এইভাবে থাকগুলো সাজাতে সাজাতে কিংশুক আবার বের করল একটা গোলাপি খাম। সুন্দর করে লাল কালিতে তার ওপরে লেখা “কিংশুককে”।
“আবার?” মুখ টিপে হাসে পূর্বা, “এটা নিয়ে কটা হল?”
“এই সপ্তাহে তিনটে। আগের মাসে আরও আটটা।”
“কি যেন নাম মেয়েটার?”
“ইয়ার্কি করো না তো! জানো না যেন? ওই যে তৃণা। আমাদের স্কুল ক্যাপ্টেন। এত গুণী মেয়ে, লেখাগুলো পড়লে চোখ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু কথা শুনলে তো! কতবার বুঝিয়ে বলেছি। শোনেই না কথা! এই ব্যপারটা স্কুলে জানাজানি হলে কি হবে বল তো?”
“কি আবার হবে? আমায় আর একটা সতিন নিয়ে ঘর করতে হবে”, বলে পেছন থেকে কিংশুকের গলা জড়িয়ে ধরে পূর্বা। চিঠিটা মুড়ে রেখে পূর্বাকে ঘুমোতে যেতে বলে কিংশুক। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার। জেলা হাইস্কুলে একটা বাংলা স্যারের ভ্যাকেন্সি হয়েছে। দেখা যাক বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে কি না।
পুনশ্চঃ
“দীপ! আই দীপ! ওঠ ওঠ! অনেক বেলা হয়েছে ওঠ বাবাই ওঠ!”
সন্দীপন বালিশটা প্রায় ভিজিয়েই ফেলেছিল। কোনরকমে উঠে ঠোঁট মুছে চোখ মুখ ধুয়ে এসে বসল। আজ শনিবার। উফ! সোলারের মুখ দেখতে হবে না। তাছাড়া কাল অনেকদিন পর মেঘার সাথে কথা হয়েছে। মেঘা স্কুলে পড়ত ওদের সাথে। দুর্দান্ত গান গাইতে পারত। মাঝখানে কয়েক বছর স্কুল ছাড়ার পর যোগাযোগ ছিল না ঠিকই, কিন্তু কাল হঠাৎ টুইটারে খুঁজে পেয়ে সন্দীপন স্কুলের স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে গেছিল। মেসেজ চলেছে অনেক রাত অবধি। একথা সেকথা করে সেই কথাটাই বলা হল না। শেষে মেঘা যখন বলল এবার সে ঘুমবে, সন্দীপন একেবারে মাস্টার স্ট্রোকটা খেলে দিল।
“আজ জানে কি জিদ না কারো” – অরিজিত সিং, HD Audio with lyrics
সোজা Youtube থেকে তুলে পাঠিয়ে দিয়ে নেট অফ করে দিয়েছে। বাকি রাতের অর্ধেক তো বুক ঢিপঢিপ করেই কেটেছে তার। কে জানে ওদিকে কি চলছে। সন্দীপন মা কালির ছবিতে কয়েকবার মনে মনে প্রণাম করে ফোনটা অন করে। মেঘ যদি একটু রাজি হয়, এবার তাহলে চাকরির জন্য জান কবুল করে মাঠে নামবে সে। হুঁ হুঁ বাবা, সন্দীপন চক্কোতি চাইলে পারে না এরকম কাজ আর আছে কটা?
নেট স্লো এই সাত সকালে। মেসেজ বক্সে Blue Tick পড়েই থেমে আছে। মেসেজটা ঢুকছে না। অফিসের একগাদা মেসেজ, কম করে পাঁচশ মেইল আর স্কুলের বন্ধুদের দুনিয়ার গালিগালাজ ঢোকার পর মেঘের মেসেজ এল। সবটা পড়া যাচ্ছে না। প্রথম লাইনটা পড়া যাচ্ছে,
“আমার খুব প্রিয় গান, কিন্তু…”
সন্দীপন হাঁ হয়ে গেল। কি? প্রিয় গান? উফ কে বলে শনি ঠাকুর অপয়া। আজ এক লিটার কাচ্চি ঘানি দেবে সে মন্দিরে। ব্রাশ করে এসে ধিরে সুস্থে সবকটা মেসেজ পড়ে নিয়ে মেঘার মেসেজটা খুলল সন্দীপন।
“আমার খুব প্রিয় গান, কিন্তু তুই এটা ভাবছিস না তো যে এত বছর পর আমি তোর জন্য single বসে আছি?”
টাইপ করার জায়গাটায় prediction-এ ‘না’ দেখাচ্ছে। টিপে দিল সন্দীপন।
Blue tick…typing… “Good. আর বল আজ কি plan? আজ তোর ছুটি না?”
সন্দীপন চা টা তুলসি গাছের গোড়ায় দিয়ে এল। মোবাইল আজ বন্ধ থাকবে। বেরনোর কোন দরকার নেই। কাজ আছে আজ সন্দীপনের। অনেক কাজ।
“ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে,
মানুষ বড় নরম, কেটে ছড়িয়ে দিলে পারত…”
মনে মনে লাইনকটা আউড়ে নিয়ে টাইপ করতে বসল সন্দীপন।
“ভালোবাসার পরতঃ
১-
সৃজার ফোন আসছে না গত দেড় মাস যাবৎ। মাঝে মাঝে চেষ্টা করে দেখেনি অবিনাশ তা নয়। কিন্তু কেবলই সৃজার মা ফোন ধরেন। সেই একই কথা…”
(শেষ)
© All rights reserved by Copyright Act 2020, Department of Art and Culture, Government of India
Copyright Office, New Delhi 110025

Comments