১
চাকরির চক্করে আর কিছু হোক না হোক, পশুপতির দাবা খেলাটা একেবারে লাটে উঠেছে। ঘাটশিলাতে আগে যেখানে থাকতেন সেখানে বাড়িওয়ালার চেনা এক ক্লাবে গিয়ে তাঁর মত কিছু দাবাড়ুর সাথে পরিচয় হয়েছিল বলে শুক্রবার বিকেল আর শনি-রবি বাঁধা ছিল তাঁর। এবার দেওঘরে আসার পর থেকে সে গুড়ে ভাঙা কাঁচ। বদলির কাজ পশুপতির। হঠাৎ জায়গা বদল করে দেয়ায় ওপরওয়ালার কাছে যথেষ্ট তদবিরও করেছিলেন তিনি। কিন্তু বড়বাবু সাফসুফ মুখের ওপর বলে দিলেন, “দেখ জোয়ারদার, তোমার ননসেন্স শখের জন্য কোম্পানি তো আর বসে থাকবে না। তাছাড়া একশ কোটির দেশে আর একটা ক্লাব নতুন জায়গায় গিয়ে আর পাবে না, এরকমটা তো নয়।” অগত্যা কি আর করা!
পশুপতির দাবার শখ সে কথা যে হেডঅফিসের লোক জানে না তা নয়। সব অফিসেই তাস-ক্যারাম-টেবিলটেনিসের একটা হিড়িক থাকে। দাবা-উৎসাহী জনগণও ছিল । তবে বিপদ বাড়ল খেলতে গিয়ে। কেউই পশুপতির সাথে জেতে না। পনের, মেরে কেটে কুড়ি মিনিট; তারপরেই ফুড়ুৎ। মাঝে মাঝে আফসোস হত তাঁর, এখানে ফাস্ট চেস, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে Blitz Chess বলা হয়, তার কদরদান নেই বললেই চলে। দাবা বলতে লোকে বোঝে চা-সিগারেট নিয়ে একটু আড্ডা হবে, মাঝে মাঝে একটু পেছনে লাগা হবে, আশপাশ থেকে বন্ধুবান্ধব এসে “আরে এটা কি করলে!” ,“ঘোড়া বাঁচাও!” ,“গজ বাড়াও!” এসব বলবে। যতসব বালখিল্য আচরণ! অফিসের খেলাগুলো তাই মিনিট দশেক চলার পরই তিনি বুঝে যেতেন পরের দানগুলো কি হতে চলেছে। তখন আর খেলার মজা থাকে না, তাই গোমড়া বদনে “আমার কাজ আছে” বলে উঠে যেতেন। অথবা বন্ধুবান্ধবদের গল্পগুজব শুরু হবার পর বিরস মুখে বলতেন, “তোমরা সবাই বরং একদিকে হয়ে বস না। দেখ জিততে পার কি না।” সেই করতে গিয়েই যত বিপত্তি। ছোকরা অনিমেশ একবার রেগেমেগে বলে বসল, “শুনুন পশুদা, বেশী কাস্পরভগিরি অন্য জায়গায় দেখাবেন। একা রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর। খেলা ছেড়ে তো একটু পরেই পিঠটান দেবেন। আবার সবাই একসাথে! নাটক দেখে বাঁচি না।”
পশুপতি জানেন এসব ছেলেমানুষদের কি করে তাতাতে হয়। তাছাড়া অনিমেশ তো আর জানত না যে তিনি দাবার বোর্ডে দানগুলো স্বচক্ষে আগে থেকে দেখতে পান। সেকথা কেউই জানে না অবশ্য। কলেজে পড়তে একবার দাবার কম্পিটিশনে তাঁর অনেক অনুরোধ-উপরোধে অস্থির হয়ে প্রিন্সিপাল সাহেব Blitz Chess করাতে রাজি হয়েছিলেন। স্টপ ওয়াচ হাতে নিয়ে স্বয়ং ভাইস চ্যান্সেলর সাহেব স্টেজে বসে ছিলেন সময় দেখার জন্য। পশুপতি চেয়ারে বসেই বুঝতে পারলেন, দাবার ছকটা কেমন জ্যান্ত জীবের মত নড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। ঘুঁটিগুলো আর ঘুঁটি নেই, সব যেন এক একটা সৈনিক, রাজা, মন্ত্রী, ঘোড়া। ভারি অবাক কাণ্ড, কিন্তু দিব্যি খাপ খেয়ে গেলেন তার সাথে। কম্পিটিশনের অতিথি প্রতিযোগী ছিল অশোক পাল, নামকরা দাবাড়ু ছিল সে। জেলা-মহকুমা পেরিয়ে রাজ্যস্তরেও সবে নাম করেছিল তখন। খেলতে বসে ঠিক সোয়া আট মিনিটের মাথায় পশুপতি পরিষ্কার দেখতে পেলেন অশোক স্পিলম্যান-গ্যাম্বিট সাজাবার একটা উপক্রম করতে পারে। তৎক্ষণাৎ তিনি প্রতিপক্ষের দুর্গ ভেঙে পরের কয়েক মিনিটে ছত্রাক্ষাণ করে তো দিলেনই, উল্টে মন্ত্রীটাকে দয়া করে না কেটে চারদিক দিয়ে নাগপাশে বেঁধে একটা বোড়ে হাতে নিয়ে নাচাতে লাগলেন। ব্যপারটা কিভাবে হল সেটা সবাই বোঝার আগেই চেক এবং মেট। অশোক পালের ভাই ছিল কলেজ ইউনিয়নের মাথা। জেলা চ্যাম্পিয়ন দাদার এহেন নাকানি-চোবানি সে কোনমতেই বরদাস্ত করল না। সন্ধেবেলা বাড়ি যাওয়ার সময় গোটাকতক গোদা গোদা ছেলে এনে পশুপতিকে বেশ ম্যারামত করে গেল। সাইকেলটা নিয়ে দুঃখ ছিল না তেমন, কিন্তু দাবার গুটিগুলো ফেলে দেওয়া হয়েছিল নর্দমায়। অপমানে পশুপতিবাবু সেগুলো আর কুড়োন নি। প্রফেশনাল দাবা খেলারও সেখানেই ইতি। মনে মনে স্থির করলেন, এবার থেকে শুধু ব্যক্তিগত শখের জন্য খেলবেন। কেবল কলেজের সেই বোর্ডটা যত্ন করে রাখা আছে।
যাই হোক, অনিমেশ বেচারা মাথা গরম করে দলবল নিয়ে বসে পড়ল ক্যান্টিনে বোর্ড পেতে। কড়ার হয়েছিল মাথাপিছু এক প্লেট বিরিয়ানি ও একটি করে কোল্ড কফি খাওয়ানোর। অর্থাৎ অনিমেশ জিতলে তার ও তার চেলা চামুণ্ডাদের সকলকে পশুপতি খাওয়াবেন। আর পশুপতি জিতলে এক প্লেট তিনি খাবেন, এক প্লেট প্যাক করে নিয়ে যাবেন বাড়ি। “শুনুন পশুদা, মাঝখানে যদি ওঠেন তাহলে আপনার বোর্ডটা কেটে টেবিলে আঠা দিয়ে সেঁটে দেব।”, অনিমেশ বেশ জোর গলায় শাসিয়েছিল। পশুপতি অভ্যেসবশে আঙুল মটকাতে মটকাতে মনে মনে ভাবলেন, “বাছা, এই চৌষট্টি ঘর থেকে আগে বেঁচে বেরও তো…”; মুখে বললেন, “না ভাই। আজ আমি কিছুতেই উঠব না। পাক্কা। তবে আমার একটা শর্ত আছে।”
“ওই ব্যাস শুরু হয়ে গেল ড্রামাবাজি।”
“না ভাই, তেমন কিছু না। আমি দেয়ালের দিকে পিঠ করে বসব। তোমরা কেউ পেছনে এসে দাঁড়ালে আমি খেলতে পারব না। মনঃসংযোগ করতে অসুবিধে হয়।”
“রাখুন তো আপনার এসব ভাঁড়ামো।”
টসে কালো গুটি ভাগ্যে পড়েছিল তাঁর। ছেলেমানুষদের রেয়াত না করে সেমি-স্লাভ ডিফেন্স সাজিয়েছিলেন পশুপতি। সেমি-স্লাভের নামই জানে না এরা, অগত্যা কিছুক্ষনেই “ধ্যার শালা চোট্টা!”, “আধবুড়ো ভাম!” ইত্যাদি বলতে বলতে অনিমেশ ও তার দলবলকে হটে যেতে হয়েছিল। পরেরবার কম্পিটিশনের আগে বড়বাবু পশুপতিকে চেম্বারে ডেকে বললেন, “জোয়ারদার, এবার তুমি আর খেলবে না কম্পিটিশনে।” হতভম্ব পশুপতির মুখের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ পরে তিনি আবার বললেন, “দেখ তোমার স্ট্যান্ডার্ডের খেলা তো এখানে কেউ খেলে না। It is more of a relaxation for people who are interested. But you! You’ve hurt few peoples’ sentiments while playing. I can’t allow people to be depressed because of a stupid recreation. I hope you understand. As an alternative why don’t we arrange grooming sessions for some interested young chaps?”
পশুপতি স্পষ্টই বুঝলেন ইঙ্গিতটা কার দিকে। বড় সাহেবের মেজ ভাইয়ের মেয়ের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে অনিমেশের। কোনমতে ঘাড় নেড়ে “আচ্ছা স্যার।” বলে বেরিয়ে পড়েন তিনি। তারপর থেকে এই বদলির কাজ। এদ্দিন ঘাটশিলাতে দাবা ক্লাবে বেশ সময় কাটছিল তাঁর। কয়েকটা নতুন দান শিখেছিলেন, শিখিয়েওছিলেন কিছু। হঠাৎ তাঁর দেওঘর বদলির কথা শুনে ক্লাবের সবাই খুবই মুষড়ে গেল।
২
“ওদিকে খিড়কির দরজা, তার চাবি আপনার গোছায় আছে। আমার আবার অম্বলের বাতিক বলে আমি খাওয়া দাওয়া সেরে আটটার মধ্যে শুয়ে পড়ি। আপনি যদি আসতে দেরি করেন দয়া করে সদর দরজা খুলে লোককে বিরক্ত করবেন না। আমার স্ত্রীয়ের আবার বাতের প্রবলেম। ছোট ছেলেটার কলেজের পরীক্ষা চলছে। খিড়কি দিয়ে ঢুকে ভেতর দিয়ে বন্ধ করে দেবেন। সকালে বেরবার সময় বাইরে দিয়ে তালা দিয়ে যাবেন। সকাল সাতটায় জল আসে, সাড়ে আটটা অবধি থাকে। দুপুরে সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা আর রাতে সাতটা থেকে আটটা। ট্যাঙ্কের জলের লাইন আপনার ঘরে করা নেই। কাজের লোক লাগলে নিজে মাইনে করে রেখে দেবেন। বারান্দা আমার কাজের লোক ছগন এসে ঝেড়ে পুঁছে দিয়ে যাবে। জুতো সিঁড়ির তলায় রাখবেন, পায়ে করে বারান্দায় উঠবেন না। আপনি মদ গাঁজা খান?” এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে থামলেন পরেশ দত্ত। পশুপতির নতুন বাড়িওয়ালা তিনি। অফিসের পিওন রাখাল, যে বাড়ির খোঁজ দিয়েছে, সে ব্যাটা আগেই বলে দিয়েছিল, “মালটা হেব্বি খিটখিটে দাদা। আগের ভাড়াটে রাতে বারান্দায় আলো জালিয়ে শুত বলে প্রায় পুলিশ ডাকছিল। তবে ভাড়াটা কম। ডিপোজিটও কম। আপনার অফিস থেকে কাছে হবে দাদা, ধরে ফেলুন। নাহলে এ তল্লাটে এই ভাড়ায় বাড়ি কেন, বেঞ্চি পাওয়াও মুশকিল।” পশুপতি একা মানুষ। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন যাপন করেন। কিন্তু এই বাড়িওয়ালা তো একেবারে যমদূতের মত হাঁক পাড়তে শুরু করে দিল প্রথম দিনেই। কোনমতে ঘাড় নেড়ে “না” বলাতে পরেশবাবু আবার বক বক করতে লাগলেন, “প্রথম প্রথম ওসব সবাই বলে মশাই। দিন গড়ালে বোঝা যায় কার পেটে পেটে কি আছে। এইত আমার এক আগের ভাড়াটে, কোথাকার কোন শাস্ত্রী না মিস্ত্রী কি যেন নাম; সে তো সন্ধে হল কি হল না গ্লাস নিয়ে বসে পড়ত ঢুকু ঢুকু করতে। আরে! ভদ্রপাড়ায় ভদ্রলোকের বাড়িতে কি এসব মানায় নাকি? দশবার বারন করেছি বাড়িতে ছোট ছেলে আছে, এসব এখানে চলবে না মশাই। কথাই শোনে না। শেষমেশ গুন্ডা দিয়ে তোলাতে হল, বুঝলেন? তারপর সেই যে বিপ্লব মল্লিক, আরেক মক্কেল? তাকে যতই বল রাতে আলো নিভিয়ে শুতে, তার নাকি ভয় করে অন্ধকারে। বুঝুন! বাজারের মধ্যে বাড়ি , তাতে আবার নাকি অন্ধকারে ভয়। আরে ইয়ের দোষ, বুঝলেন না? ওই বড়রাস্তার কোনায় একটা নাচের ইস্কুল আছে, সেখানে দুনিয়ার যত আঁটকুড়ে ধিঙ্গি মেয়ে এসে সন্ধ্যা হলেই ধেই ধেই করে …” পরের কথাগুলো আর শোনার রুচি হল না পশুপতির। ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন বেশ আলো হাওয়া খেলছে এই সকালবেলাই। অ্যাটাচ বাথরুম আর ছোট একটা রান্নাঘর। দেখলে বোঝা যায় কোনদিন হয়ত এদিকেও একটা বারান্দা ছিল। বসার ঘর বলে আলাদা কিছু নেই। খাটের থেকে হাত তিনেক দূরে ঘরের প্রায় মাঝখানে একটা ছোট নিচু টেবিল। একজোড়া কাঠের চেয়ার মুখোমুখি রাখা। আর একটা পুরনো জং ধরা গোদ্রেজের আলমারি। ব্যাস! পরেশবাবুর কথা কানে এল, “শুনুন, আমি কোন ঝামেলায় জড়াতে পছন্দ করি না। তাই আগে থেকে স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি। রাত আটটার পর মেইন গেট বন্ধ। বন্ধুবান্ধব এলে সাতটার মধ্যে ঘর খালি করিয়ে দিতে হবে। আত্মীয় পরিজন বাদে মেয়েমানুষ আনা অ্যালাউড না। আর মদ বিড়ির গন্ধ যদি পাই পরের দিন সকালে পুলিশ ডেকে বের করিয়ে দেব। ডিপোজিটের এক পয়সাও ফেরত দেব না। মাসের তিন তারিখের মধ্যে আমার ভাড়া চাই। নগদ। ক্যাশ। ওসব চেক-টেকের ঝামেলা করতে হলে অন্য জায়গায় করবেন। দেখি টাকাটা।” পশুপতি বিনা বাক্যব্যায়ে টাকাকটা গুঁজে দেন পরেশবাবুর হাতে।
“আচ্ছা ওদিকের দরজাটা বন্ধ কেন? ওটা কিসের দরজা?”
“ওটা ছোট স্টোররুম। বাইরে দিয়েও দরজা আছে, বাথরুমের পাশে। সেই দরজার চাবি আমার কাছে। আর এই দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। আপনার কিছু রাখবার মত আছে নাকি? বাক্সপ্যাঁটরা?”
“আজ্ঞে না, আমার জিনিসপত্র খুব সামান্য।”
“অ। তা ভালো। ওই নচ্ছাড় বিপ্লব মল্লিকটাকে বের করার সময় তার কিছু মাল আমি আটকে রেখেছিলুম। সেসব এখনও পচছে ওই ঘরে। বলেছিলুম ক্ষমতা থাকে তো মামলা করে আদায় করো। আমার নামও পরেশকুমার দত্ত। নয় নয় করে হলেও দশ বছরের এক্সপিরিয়েন্স বাড়িভাড়া দেয়াতে। আরে মানুষ দেখে বুঝে যাই সে ভদ্রলোক না গাঁটকাটা মশাই!” বলতে বলতে দোতলায় অদৃশ্য হয়ে যান পরেশবাবু।
আলমারিটা খুলতে বেশ বেগ পেতে হল পশুপতিকে। বেশ কিছুক্ষণ টানা-হ্যাঁচড়া করার পর বিকট শব্দ করে পাল্লাটা খুলে গেল। ভেতরে কিছুই নেই। ওপরের তাকগুলো হাত বাড়িয়ে হাতড়ে দেখতে লাগলেন তিনি; এটা তাঁর বরাবরের অভ্যেস। একটা শুকনো জংধরা ব্লেড, গায়ে লাল লাল ছোপ। আর কিছু নেই। বাথরুমে একটা বালতি আর একটা মগ। এবারে চোখে পড়ল যে আয়নাটা আসলে একটা তাক। ভেতরে মাজন-ব্রাশ-সাবান রাখার জায়গা করা। একটা টিমটিমে বাল্ব। বাইরে এসে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে পশুপতি মাটিতে একটা দাবার ঘুঁটি কুড়িয়ে পেলেন। এ তো একটা মন্ত্রী! হাতে করে মন্ত্রীটা উঠিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন পশুপতি, এটা এতক্ষণ চোখে পড়েনি কেন ভাবতে অবাক লাগল তাঁর। কালো ঘুঁটি। মাথাটা গোল। দেখলে হঠাৎ দাবার ঘুঁটি বলে মনেই হয় না, পেনের ভাঙা টুকরো বলে ভুল হতে পারে। তলাটা সাদা, পালিশ করা। অস্পষ্ট করে ‘ব’ লেখা। চিন্তিত হয়ে ভাবতে থাকেন পশুপতি। ‘ব’য়ে ‘বিপ্লব’ নাকি? জিনিসপত্র আনতে গিয়ে তাঁর দাবার ছকের কালো মন্ত্রীটা হারিয়ে গেছে ঘাটশিলাতে। একটা ফাউন্টেন পেনের ঢাকনা দিয়ে কাজ চালাচ্ছিলেন তিনি। যাক! মন্দের ভালো। একটা ঘুঁটি জুটে গেল দিব্যি বিনি পয়সায়। নাহলে একটা ঘুঁটি হারানো মানে গোটা একটা সেট একেবারে নষ্ট। জিনিসপত্র কোনমতে গুছিয়ে নিয়ে দাবার বোর্ডের ব্যাগটা বের করেন তিনি, শখ করে শান্তিনিকেতন থেকে কেনা বাহারের কাজ করা কাপড়ের ব্যাগ। তার ভেতরে কাঠের একটা সস্তা বাক্সে রাখা দাবার বোর্ড আর ঘুঁটিগুলো। মন্ত্রীটা ব্যাগস্থ করে ঘর গোছানোয় মন দিলেন পশুপতি। দুপুরের জলে স্নান করতে গেলেন। নাঃ! বোর্ডটা মা সরস্বতীর কৃপায় যখন আবার পুরিয়ে গেল তখন একটা হাত না খেললেই নয়।
স্নান করতে করতে চাপা একটা উত্তেজনা অনুভব করলেন পশুপতি। ফাউন্টেন পেনের ঢাকনা দিয়ে মন্ত্রী বানানো যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত। আজ তাহলে ববি ফিশারের বিখ্যাত সিসিলিয়ান ওপেনের সাথে নিজের দান মিশিয়ে তিনি যে বিটকেল বিদঘুটে খেলাটা বুনেছেন, সেটার হাতে কলমে একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। ব্যপারটা কেমন দাঁড়ায়, আদৌ দাঁড়ায় কি না, সেটা মেপে দেখবার জন্য একটা সেইরকম ডিফেন্স দরকার। সেটা কি নিমজো ইন্ডিয়ান হতে পারে কি না ভাবতে গিয়ে সাবানটা হাত পিছলে দুবার পড়ে গেল মেঝেতে। ইশ! বাড়িতে একটা দাবার ঘুঁটি পড়ে আছে, তেমনি যদি একটা দাবাড়ুও পড়ে থাকত কি ভালোই না হত, এসব আজগুবি ভাবনা ভাবতে ভাবতে স্নান সারেন পশুপতি। বেরিয়েই মনে হল, এক কাপ চা হলে অন্তত পিত্তটা রক্ষা করা যেত। হাতের কাছে দুধ চিনি চা পাতা এসব কিছুই নেই। আচ্ছা ওপরে গিয়ে পরেশবাবুকে এক কাপ চায়ের কথা বললে ভদ্রলোক কি খুব বিরক্ত হবেন? একটু আগে এক কাঁড়ি কড়করে টাকা গুনতে গুনতে ওপরে গিয়েছেন পরেশবাবু, এক কাপ চা চাইলে কিই বা মহাভারত অশুদ্ধ হবে। যদিও তাঁর মেজাজখানা একটা ভাববার বিষয়।
মনে মনে ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে পশুপতি ঘরের বাইরে এসে একটা লোকের মুখোমুখি পড়ে গেলেন। লোকটা একটা খাটো লুঙ্গি পরে উবু হয়ে বসে সিঁড়িতে ঝাঁটা বুলোচ্ছিল। সারা মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় টাক। টিংটিঙে বেঁটে চেহারায় দাড়িটা খুবই বেমানান, হঠাৎ দেখলে সিন্ডারেলার গল্পের বামনের বর্ণনা মনে আসে। লোকটার ফতুয়ায় জুতোর কালি অথবা গ্রিসের দাগ আর হলুদের ছোপ দেখে তাকে ছগন ঠাওরালেন পশুপতি। সামনে গিয়ে সামান্য কেশে জিজ্ঞেস করলেন, “এক কাপ চা পাওয়া যাবে ভাই?”
লোকটা মুখের দিকে তাকাল। চোখদুটো হলুদ, মণিটা কুচকুচে কালো আর ভাবলেশহীন। দেখে এই ভরদুপুরেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল পশুপতির।
“আভি রান্নাঘরমে হামকো জানে কি মানাই হ্যায় বাবু। শাম সে পেহলে চা হবে না। আভি দিদিজি সোনে চলে গ্যায়ে।”
দিদিজি, অর্থাৎ পরেশবাবুর স্ত্রী।
নিরাশ হয়ে পশুপতি কি করবেন ভাবছেন, এমন সময় বুড়োটা আবার বলল, “আপকো চায় পিনা হ্যায় তো বাহার মিলেগা। এখান থেকে সিধা গেলেই বাজার। বাজারকে অন্ত মে একঠো দুকান মিলেগা বাবুজি।” ছগনের বয়ানে দোকানটা তারই দেশজ ভাই ভাগীরাম চালায়, অমন চা নাকি ভূভারতে কেউ বানাতে পারে না। সেখানে গেলে রাত দশটার আগে যেকোনো সময় ‘চায়-নাশতা’ মিলতে পারে। খাবারের সন্ধান পেয়ে পশুপতি সিসিলিয়ান ওপেন মাথায় তুলে ছাতাটা বগলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
বাজারটা নামেই বাজার। বেশিরভাগ দোকান বন্ধ। একটা বাটার জুতোর দোকান, একটা মুদিখানা, গোটাদুয়েক মাছ-মাংস আর একটা লটারির স্টল ছাড়া আর তেমন কিছু খোলা নেই। বাজারের এদিকটায় মাঝখানে একটা মিষ্টির দোকান চোখে পড়ল পশুপতির, ভেতরে সম্ভবত বিকেলের জন্য গজা ও ভেজিটেবিল চপ জাতীয় কিছু তৈরি হচ্ছে। বাজারের রাস্তায় নানা জায়গায় নানবিধ সব্জির খোসা জড় করা দেখে তিনি বুঝতে পারলেন, এখানে কোন পাকাপাকি সব্জির দোকান নেই। সম্ভবত লোকে ঠ্যালা করে নিয়ে আসে, এখন গিয়েছে কাছেপিঠে খেতে বা বাড়িতে। ছগনের কথা মত চলে বাজারের একেবারে শেষপ্রান্তে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান পাওয়া গেল। অবিকল ছগনের মতই দেখতে একটা বুড়ো চায়ের জল বসিয়ে একটা নোংরা টেবিলফ্যান চামচ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে উনুনের সামনে বসিয়ে চালানোর চেষ্টা করছে। গলগল করে বেরোচ্ছে ধোঁয়া। লোকটার চেহারায় ছগনের সাথে আশ্চর্য মিল। মাথায় কেবল ইঞ্চিদুয়েক বেশী লম্বা আর অল্প অল্প চুল আছে। দাড়ি কাঁচাপাকা হলেও চুলকটা সাদা। পশুপতিকে বোধহয় নতুন দেখছে বলে বুড়ো মিনিট খানেক চেয়ে রইল। তারপর নিঃস্পৃহভাবে “আইয়ে বাবুজি” বলে একটা ভাঙা প্লাস্টিকের টুলে বসতে দিল। পশুপতি সাবধানে বসতে বসতে বললেন, “ইয়ে, চায়-নাশতা কিছু কি মিলেগা?” উত্তরে বুড়ো ভাগীরাম জানালো ‘বেশক’ মিলেগা। চায়ের উনন ধরলেই সে পাঁউরুটি এবং ডিম ভেজে দিতে পারে। সকালের ঘুগনিও কিছুটা আছে, তবে গরম করতে হবে। বাবুজি যদি তাকে আধ ঘণ্টা সময় দিতে পারেন তাহলে সে আটার রুটিও করে দিতে পারে। উননের ধোঁয়ায় উৎসাহের বিশেষ অভাব লক্ষ্য করে পশুপতি শেষে চা এবং ডিম-পাঁউরুটির অর্ডার দিয়ে পকেট থেকে বিড়ির বান্ডিল বের করে দেশলাই চাইলেন।
“উঁ তো হামরে পাস নেহি আছে বাবুজি। হামার দুকানে বিড়ি-সিরগেট রাখি না। আপনি একটু বাজারের দিকে চলিয়ে যান।”
আজব মুশকিল! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন পশুপতি একটা গোটা দেশলাই বাক্স নিয়ে লোকটা কসরত করছে কয়লা ধরাবার জন্য, আর তাঁর বিড়ি ধরাতে একটা কাঠির জন্য কি না বাজারে যেতে হবে আবার? নেহাত দোকানপাট খোলা নেই তাই, নাহলে ভাগীরামের চায়ের ভাগ পত্রপাঠ নাকচ করে দিতেন তিনি। বিরক্ত মুখে ছাতাটা নিয়ে উঠতে গিয়ে টুলের ভাঙা কোনাটায় লেগে ছাতার দুটো শিক বেরিয়ে এল কাপড় ছিঁড়ে। ভাগীরাম যেন দেখেও দেখল না। এখানে কি চাকর-মালিক-চাওয়ালা সবাই নবাব নাকি? আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে পশুপতি আবার বাজারের দিকটায় চলে এলেন। বাজারের একটা দিক ছাউনি করা। ভেতরে কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট দোকান, দুটোর ঝাঁপ ফেলা। একটা ব্যাগ-ছাতা সারাইয়ের দোকান অর্ধেক খোলা দেখে এগিয়ে গেলেন পশুপতি, ছাতাটা সারাতে দিয়ে দোকানওলার কাছ থেকেই দেশলাই চাইলেন। দেশলাই না, একটা লাইটার দিল দোকানী। লাইটারটা নিয়ে আর একটু বাজারের ভেতর দিকে গেলেন তিনি, বন্ধ দোকানগুলোর সামনে যত্ন করে বিড়ি ধরালেন।
“পরেশবাবুর বাড়িতে নতুন এলেন নাকি?”
পুরনো পাম্প চললে যেমন গোঁ গোঁ শব্দ হয়, তেমনি আওয়াজে কথাগুলো শুনে বিড়িটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল হাত থেকে। চমকে পশুপতি ঘুরে দেখলেন একটা বন্ধ দোকানের পেছন থেকে একটা লোক বেরিয়ে এসে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়েছে। লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল, “কি? পরেশবাবুর নতুন ভাড়াটে?” লোকটার গায়ে একটা কলার অবধি বোতাম আঁটা জামা, কোন সময়ে সেটা নীল ছিল, এখন ফ্যাকাসে চুনকাম ধরণের একটা রং হয়েছে। হাতা দুটো কনুইয়ের নিচ অবধি গোটান, বাঁ হাতে একটা পুরনো তামার আংটি। মুখের দাড়িগোঁফ পরিষ্কার করে কামানো, চোখের দৃষ্টি শান্ত। মাথায় এত তেল দিয়ে চুল পেতে আঁচড়ান যে দেখলে মনে হয় তেল বেয়ে পড়বে একটু পরেই। গায়ে একটা অস্বস্তিকর খালের গন্ধ।
“আপনাকে আজ দেখলুম টেম্পো করে মালপত্র এনে নামালেন।”
কথাটা ডাহা মিথ্যে। পশুপতি এসেছেন রিকশায়, পেছনে আর একটা রিকশা করে মাল। এও কি বাড়ির দালাল নাকি? গম্ভীর মুখে বিড়িতে দুটো টান দিয়ে তিনি বললেন, “আজ্ঞে না। অন্য কাউকে দেখেছেন।” লোকটা একইরকম গলায় একটা গ্যাদগ্যাদে ভাব এনে বলল, “তা হতে পারে। কোথা থেকে আসছেন? এই দুপুরবেলা এদিকে কি মনে করে?”
আচ্ছা গায়ে পড়া লোক তো! কলকাতা হলে এতক্ষণে “তোমার কি দরকার হে চাঁদু?” বলে বেশ কোণঠাসা করে ফেলা যেত ব্যাটাকে। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁয়ে এসে এসব বিটকেল মানুষদের ব্যাপারে নাক গলাতে মন সায় দিল না পশুপতির। কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বললেন, “দার্জিলিং থেকে এসেছি আজ সকালে। ভাবলাম বাজারে একটু হাওয়া খেয়ে আসি।”
“তা বেশ! তা বেশ! হাওয়া বদলের জন্যই তো লোকে দেওঘর আসে মশাই। সেই শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে কত মহীয়সী…”
বিড়িটা ফেলে দিয়ে নমস্কার করে এগোতে গেলেন পশুপতি। ছাতাটা এতক্ষণে সারানো না হয়ে গিয়ে থাকলেও লোকটাকে পাশ কাটানো দরকার। লোকটা হঠাৎ পেছন থেকে ডেকে বলল, “ও মশাই! শুনছেন? আরে চললেন কোথায়?”
“কি দরকার বলুন তো?”, পশুপতির গলা শক্ত হল।
“না মানে কিছু মাইন্ড না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“কি জিজ্ঞেস করছেন তার ওপর ডিপেন্ড করে মনে করব কি না। ঝেড়ে কাশুন।”
একটু লজ্জিত হেসে হাত-টাত কচলে লোকটা এবার জানতে চাইল, “মশায়ের কি দাবার শখ নাকি?”
পশুপতি অবাক হয়ে গেলেন। লোকটা কি থট-রিডিং জানে নাকি? ঘণ্টাকতক আগে এখানে এসেছেন, এর মধ্যেই চার চারটে আজব প্রাণীর সাথে দেখা হয়ে গেল। কি ভেবে “না” বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না পশুপতি। লোকটাকে ঠিক দালাল তো মনে হচ্ছে না। চোর দেখেছেন পশুপতি বিলক্ষণ। ছেলেবেলায় তাঁর বাড়িতে একবার চোর এসেছিল সিঁধ কাটতে। তাকে ধরে পশুপতির দাদু এক পাড়া লোকের সামনে কান ধরে ওঠবস করিয়েছিলেন পঞ্চাশবার। কালো লিকলিকে প্রেতের মত চেহারা ছিল তার, গলায় একটা কণ্ঠির মালা। এই লোকটাকে এক নজর দেখে ঠিক চোর-ছ্যাঁচড়ও মনে হয় না। ভেবে চিনতে বললেন, “কেন বলুন তো?”
“আপনাদের বাড়ির পেছনেই বলাই ঘোষের বাগান। সেখানে একটু পাতিলেবু আনতে গিয়েছিলুম। তা দেখলুম ঘরের জালনা খোলা, আপনি একটা দাবার বোর্ড বের করলেন ব্যাগ থেকে। তারপর মাটি থেকে কি একটা তুলে দেখেশুনে ব্যাগে পুরলেন। তাই ভাবলুম একটু খুঁচিয়ে দেখি।”
বাঃ! বেড়ে স্বভাব তো লোকটার। ভরদুপুরে লোকের বাগান থেকে লেবুচুরি, অন্য বাড়ির জানলা দিয়ে উঁকি দেয়া, অপরিচিত মানুষকে ফাঁকা জায়গায় হেনস্থা করা, সবরকম সদগুণই আছে। পশুপতি এক মুহূর্তের জন্য ভাবলেন, লোকটা কি পুলিশের লোক? পুলিশের অনেক লোক সাদা পোশাকে চরবৃত্তি করে বেড়ায় বলে কোথায় একটা পড়েছেন মাসখানেক আগে। কিন্তু তাঁর মত ছাপোষা কেরানীর পেছনে সরকার বাহাদুর পুলিশ লেলিয়ে কি করবে, সেটা ঠিক ভেবে পেলেন না তিনি। লোকটা বোধহয় বুঝতে পারল দোনামোনার কারণটা। হেসে বলল, “মাপ করবেন। আসলে দাবা দেখলে মাথার ঠিক থাকে না একেবারে। আমার বড্ড শখ কি না। কিন্তু ভালো খেলার লোক পাই না তেমন জানেন তো। লোকে তাস-পাশা-ঘোড়ার রেস সব নিয়ে মাতামাতি করে। ফুটবল-ক্রিকেটের ভক্তও কম না। কিন্তু এই যে এতবড় খেলাটা পড়ে পড়ে ধুলো খাচ্ছে আমাদের দেশে, সেইটেই সবার নজর এড়িয়ে গেল।” পশুপতি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বটে! দাবাড়ু! তবে না জেনেশুনে একটা অচেনা লোককে হঠাৎ সব খুলে বলে ফেলাটা ঠিক হবে কি না সেটা মনে মনে ভাবার চেষ্টা করলেন। লোকটাই বলল, “আসুন না সন্ধের দিকে শিবগঙ্গার দিকটা। আমি ওদিকেই থাকি। লেকের ধারে হাওয়া খেতে খেতে একহাত হয়ে যাবে।”
সংক্ষেপে “দেখছি” বলে এগোলেন পশুপতি।
“মশায়ের নামটা?”
“আমার নাম পশুপতি। পশুপতি জোয়ারদার। আপনি?”
লোকটা হাত জোর করে নমস্কারের ভঙ্গিতে তুলল।
“অধমের নাম বিপ্লব। বিপ্লব কুমার মল্লিক।”
৩
বিপ্লব মল্লিকের সাথে দেখা হওয়াটা খুবই আকস্মিক এবং আশ্চর্যও বটে। পশুপতি এর মধ্যে লোকটিকে আর দেখেননি। রাস্তায় বাজারে সব জায়গাতেই খেয়াল করেছেন যেতে আসতে, তবে চোখে পড়েনি। অফিসে রাখাল খোঁজ খবর করতে এসেছিল। জাঁকিয়ে একটা টুলে বসে বলল, “কি দাদা? সব খবর ভালো তো? নতুন জায়গা কেমন লাগছে?” ইতিমধ্যে বাড়িতে তেমন অসুবিধে হয়নি পশুপতির। কাজের লোকের বালাই বা সামর্থ্য কোনটাই তাঁর নেই। নিজের হাতে জিনিসপত্র গুছিয়ে রান্না করে খাচ্ছেন। মা চলে যাওয়ার পর অন্য কারো রান্না মুখে তেমন রোচে না তাঁর। প্রথম প্রথম বিস্তর হাত পুড়িয়ে এখন ঝোলভাতটুকু নিজের আয়ত্তে এসেছে। বললেন, “না। কি আর অসুবিধে হবে? আমি একলা মানুষ।”
“আরে দাদা, আপনার আগে যারা ছিল ওখানে সবাই একলাই ছিল। ওই পরেশবুড়োই যত গোলমালের আখড়া। শুনেছি বাড়িতে নাকি একেবারে মিলিটারি রুল চালিয়ে রেখেছে? কেউ ট্যাঁ-ফোঁ করলেই ক্যাঁক করে ধরে গিয়ে? সত্যি নাকি?”
একটা কথা রাখালের কাছে চেপে গেলেন পশুপতি। ঘটনাটা পরশুর। সেদিন সাড়ে ছ’টার মধ্যেই ফিরে গিয়েছিলেন তিনি। ঘরে ঢুকে আলো জ্বালানোর আগে একটা হাল্কা জংলা গন্ধ টের পেলেন তিনি। ঠিক গাছের বা পাতার না, খানিকটা খানা বা পচা ডোবার মত। এরকম গন্ধ তিনি আগে কোথাও পেয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন না কোথায়। আলোটা জ্বালতেই চোখে পড়ল, টেবিলের ওপর একটা সাদামত কি রাখা। ছোট্ট লম্বাটে জিনিসটা নিয়ে হাতে নেড়েচেড়ে দেখলেন, ওটা একটা সাদা বোড়ে। দেখতে অবিকল মন্ত্রীটার ধাঁচের, কেবল সাইজে ছোট আর রং সাদা। পশুপতির এবার বেশ খটকা লাগল। তাঁর সাদা বোড়েদের একটি সম্প্রতি ভেঙে গেছে। বোর্ডের ঘুঁটিগুলো কাঠের, আর বেশ পুরনো। অনেক সময় টুকরো টুকরো রং খসে পড়ে। এবারের দোষটা যদিও তাঁরই। রবিবার বিকেলে চা নিয়ে বসেছিলেন তাঁর নতুন খেলাটা একটু ঝালিয়ে নিতে। একটা সাদা বোড়ে হঠাৎ টেবিল থেকে পড়ে যায়। টেবিলটা বেশ নিচু, আর ঘুঁটিগুলো এর আগেও বহুবার হাত থেকে পড়ে গেছে। কাজেই অন্যমনস্কভাবে কুড়োতে গিয়ে হঠাৎ হাতে খোঁচা খেয়ে দেখলেন, বোড়েটা ভেঙে গেছে। ভেঙেছেও ভারি অদ্ভুতভাবে, লাউ ফালা দেয়ার মত মাঝখান দিয়ে। ভাঙা ঘুঁটিটা হাতে নিয়ে কোন কুলকিনারা করতে পারেন নি পশুপতি। কস্মিনকালেও ঘুঁটি কেন, কোন জিনিস এভাবে হাত থেকে পড়ে ভাঙতে দেখেননি তিনি। মনটা বেশ খারাপই হয়েছিল তাঁর। তারপর এই সাদা বোড়ের আগমন। আগেরবার এসেছিল মন্ত্রী। তাহলে কি কোন অজ্ঞাত ক্ষমতাবশে কোন ঘুঁটি ভাঙলে তার জুড়িদার চলে আসছে? একথা সেকথা ভেবে সাদা বোড়েটাকে বাক্সে শেষপর্যন্ত ঠাঁই দিয়েছেন পশুপতি, তবে অনেক চেষ্টা করেও ধরতে পারেননি যে এই নতুন ঘুঁটিগুলো কিসের তৈরি। এবার ঠিক করেছেন, একটা ঘুঁটি তিনি ইচ্ছে করে হারিয়ে দেখবেন তার জোড়াও এসে উপস্থিত হয় কি না।
সন্ধেবেলার মুখে বেশ ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়াতে অফিসে আটকে পড়েছিলেন পশুপতি। রাখাল বেরোবার সময় বলল, “দাদা, আমার কাছে একটা বাড়তি ছাতা আছে। ক্যারিয়ারে উঠে পড়ুন না, ছেড়ে দিচ্ছি?” কদিন আগে নতুন বাটার চটি কিনেছেন পশুপতি। পায়ে বুড়ো আঙুলের ফাঁকে একটা ফোস্কা হওয়ায় এমনিতেই বেশ যন্ত্রণা, তার ওপর ক্যারিয়ারের ঝাঁকানি আর সইবে না। হেসে তাই বললেন, “না হে রাখাল। তুমি বরং এগোও, আমি জল কমলে একটা রিকশা করে নেব।“ ফিরে এসে খিড়কি দিয়ে ঢুকে দেখলেন, পরেশবাবু ছগনকে নিয়ে তাঁর ঘরের সামনে কি যেন করছেন। এখন সাড়ে আটটা, তাঁর শুয়ে পড়ার কথা। ঢুকতে ঢুকতেই বক বক শুরু হয়ে গেল।
“কি ঝামেলা দেখুন দেখি! সকাল থেকে রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ। বাড়ির বিড়ালটা অবধি ছাদে যেতে পারল না। বিকেল হতে না হতে কোত্থেকে অলুক্ষুনে মেঘ এসে চারপাশ একেবারে ভাসিয়ে দিল মশাই? কি ঝড় কি ঝড়! আপনার জালনার ঠিক উপরে একটা মস্ত বোলতার চাক হয়েছিল, সেই চাক ভেঙে একেবারে সানসেটের ওপর পড়ে হই হই কান্ড। সমস্ত বোলতা এসে আপনার ঘরে ঢুকে গেল। জল থামলে পর এই ছগনাকে নিয়ে ধোঁয়া করে তবে সব বোলতা তাড়ালুম। আমিও তেমনি বাড়িওলা নই মশাই, যে ভাড়াটের সুবিধে অসুবিধেটুকুও দেখব না। একদম ক্লিয়ার করে দিয়েছি। তবে হ্যাঁ, রাতে একটু মশারি টানিয়ে শোন কদিন। বলা যায় না এক দু’পিস থেকে গেলে মাসের মাঝখানে ডাক্তারের ফিজ গুনতে হবে। জালনার পাল্লাটা ঝড়ে নড়বড়ে হয়ে খুলে গেছে। আমি কালকে ঠিক করিয়ে দেব মিস্তিরি ডেকে। হ্যাঁ মিস্তিরির টাকাটা আপনাকে দিতে হবে না মশাই। আমার বাড়ি! আমার জালনা! আমার পাল্লা! আরে এখনই কোথায় ঢুকছেন? ঘরে ধোঁয়া আছে এখনও…”
কোনমতে গুঁতো মেরে ঠেলে সরিয়ে ঘরে ঢুকে পশুপতি দেখলেন, যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। ঘুঁটির বাক্সটা তিনি রেখে গিয়েছিলেন জানলার ধারে তাঁর চশমার বাক্সের সাথে। চশমা পড়ে কাঁচটা টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। আর ঘুঁটির বাক্সটাও ফেটে গেছে অত ওপর থেকে পড়ে। মেঝেতে ছড়িয়ে ঘুঁটি, সেগুলো কুড়োচ্ছে ছগন। হাঁ হাঁ করে হামলে পড়লেন পশুপতি, প্রায় মাথা খারাপ হওয়ার মত অবস্থা।
“আপনি কি মশাই দাবা খেলেন নাকি? এটা তো জানা ছিল না” পরেশবাবু ভুরু কুঁচকে এগিয়ে আসেন। পশুপতির নাক তখন প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে ধোঁয়ার প্রকোপে। ছগন একটা হাত পাখা নেড়ে নেড়ে ধোঁয়া বাইরে বের করার চেষ্টা করছে জানালা দরজা দিয়ে।
“কি মশাই দাবা খেলেন নাকি?”
ভারি বিরক্ত হয়ে পশুপতি জবাব দেন, “না মশাই! টেবিলে সাজিয়ে ইকিরমিকির খেলি!”
“সে যাই বলুন, ছোটবেলায় আমার হয়েছিল ভারি তাসের শখ। রথের মেলা থেকে এক সেট তাস কিনে ভাইবোনেরা দুপুরবেলায় ছাদে বসে খেলতুম। বড়জ্যাঠামশাই পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে হাতে নাতে ধরে ফেলে বাবাকে দিয়ে পঁচিশ ঘা জুতোপেটা করালেন। সেই থেকে জানি ‘তাস-দাবা-পাশা, তিন কর্মনাশা’। আমি তো বলব মশাই গেছে আপনার ভালোই হয়েছে। কাল থেকে সকালে আমার সাথে একটু যোগব্যায়াম অভ্যাস করুন, বুঝলেন? দেখবেন শরীর মন সব চাঙ্গা হয়ে উঠবে। মাথা ঠাণ্ডা হবে।”, বলতে বলতে পরেশবাবু একটি অম্বলের উদ্গার ছেড়ে দোতলার দিকে প্রস্থান করলেন।
পশুপতি একটি কথাও না বলে গুম মেরে রইলেন। না, আজ আর খাওয়া দাওয়া মুখে রুচবে না; আগে দেখতে হবে ঘুঁটিগুলো কোনদিকে কোনটা গেল। বেশীরভাগ এদিক ওদিক গড়িয়ে গেছে। ভেঙেছে কয়েকটা। সব মিলিয়ে দেখলেন; সাদাকালো মিলিয়ে সাতটা বোড়ে, তিনটে গজ, একটা সাদা নৌকো আর একটা কালো ঘোড়া হারিয়ে বা ভেঙে অকেজো হয়েছে। নাঃ! যথেষ্ট! এবার নতুন বোর্ড একটা কিনতেই হবে যেভাবে হোক। পশুপতি প্রায় ঠিক করে ফেললেন কালই গিয়ে ক্যাশিয়ারের সাথে কথা বলবেন যদি একশটা টাকা আগাম পাওয়া যায়। কি অজুহাতে টাকাটা চাইবেন ভাবতে ভাবতে ছগন হঠাৎ একটা প্রশ্ন করল।
“বাবু, আপ ভি শতরঞ্জ খেলতে হ্যায় ক্যায়া?”
“হ্যাঁ।”
“রোজ খেলতে হ্যায় ক্যায়া?”
কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকালেন পশুপতি। ছগন একইরকম নিস্পলক ঠাণ্ডা চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, ফতুয়াটা ঘামে ভেজা। বোঝাই যায় এই বয়সে হঠাৎ ধকলটা তার তেমন সহ্য হয়নি। পশুপতি একটু অবাক হয়ে জবাব দিলেন, “হ্যাঁ মানে রোজ খেলি না। ওই সময় পেলে। আচ্ছা এখানে কোন চশমার দোকান আছে?”
“আছে বাবু। বাজারের পিছনের দিকে গেলে পেয়ে যাবেন,” বলে ছগন আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ছিল। চৌকাঠ পেরিয়ে হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, “বাবু, বুরা না মানলে একটা কথা বলব?”
“কি কথা?”
“এ খেলা আপনি ছোড়িয়ে দিন বাবু। জানলেবা খেলা এ।” বলে বারান্দায় মিলিয়ে গেল ছগন।
এ বাড়ির মালিক চাকর সবাই মনে হয় এক খাটালের গোরু। মনে মনে বিরক্ত হয়ে কোনরকমে দুটো মুড়ি চিবিয়ে শুয়ে পড়লেন পশুপতি। ক্যাশিয়ারকে কি বলবেন ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুম এসে গেল তাঁর। অনেক রাতে ঘুমের মধ্যে টের পেলেন, ঘরের বাতাস ভরে উঠেছে সেই খালের গন্ধে। অন্ধকারে চোখ মেলে কিছুই তেমন দেখতে পেলেননা তিনি। খোলা জানলা দিয়ে চোখে পড়ল, মশারির মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে আকাশের তারা। এপাশ ওপাশ করে ফের ঘুমিয়ে পড়লেন পশুপতি।
৪
ক্যাশিয়ার ধনিরাম অতি ধুরন্ধর লোক। পশুপতির মিথ্যেটা এক লহমায় ধরে ফেলল। বলল, “জুতোর ফোস্কার জন্য ডাক্তারের ফিজ একশ টাকা! কোন ডাক্তার মশাই? আমার ছেলেটার কানে একটা ফোঁড়া হয়েছে।” পশুপতি আমতা আমতা করে বললেন, “ইয়ে আমাদের পাড়াতে একজন অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার।”
“আগেই দিনকাল ভালো ছিল মশাই। লোকে কোবরেজ ডেকে চিকিৎসে করাতো, আর ফিজের নামে কলা মুলো চাল যা পারত দিয়ে দিত। আমার দিদিমার বয়েস তখন সেভেন্টি নাইন। সেবার পেটের ব্যাথায় জেরবার হয়ে সদরের ডাক্তারখানায় দেখান হল। ডাক্তার তো দেখেই বলল পেট কাটতে হবে, পাঁচ হাজার টাকার ধাক্কা। আমাদের পাড়ার কোবরেজ এসে দেখে তিন দিনের ওষুধ দিয়ে দিল। ফিজ নিল পনের’ টাকা আর এক কেজি গোবিন্দভোগ চাল। তিন দিনের মাথায় ব্যথা-ট্যাথা একেবারে হাপিশ,” বলতে বলতে খসখস করে ভাউচার সই করে দিল ধনিরাম, “যান। কাউন্টারে ভাউচার দেখিয়ে টাকাটা তুলে নিন। আর পরেরবার জানলা দরজা ভালো করে বন্ধ করে বেরবেন মশাই। এখানের আবহাওয়া কলকাতার মত নয়। এই দেখছেন রোদ, হঠাৎ দেখবেন ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমে গেল।”
অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরলেন পশুপতি। আজ শুক্রবার। সোজা একটা রিকশা নিয়ে চলে এলেন বাজারে। ছগনের কথামত একটা চশমার দোকান পাওয়া গেল। চশমাটা দেখে দোকানের লোক বলল, “না বাবু। এই পাওয়ারের কাঁচ আমার কাছে রেডিমেড নেই। আর এরকম ফ্রেমও নেই। আপনি বরঞ্চ এক কাজ করুন। চোখের ডাক্তার দেখিয়ে আমায় পাওয়ারটা কাগজে লিখে দিয়ে যাবেন। আমি ফ্রেম আর কাঁচ পাটনা থেকে করিয়ে আনিয়ে দেব।” বেরতে বেরতে পশুপতি একবার কি ভেবে লোকটাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে ছোটদের খেলনার দোকান আছে?”
লোকটা বলল, “আছে। এই তো এদিক দিয়ে সোজা চলে যান। খেলাঘর বলে একটা দোকান পড়বে। সব পেয়ে যাবেন। বল, ব্যাট, এরোপ্লেন, চাবি দেয়া মোটরবাইক।” পশুপতি একটু কান চুলকে বললেন, “না। একটা দাবার সেট খুঁজছি।”
“ও,” বলে লোকটা এক মিনিট ভেবে বলল, “এক কাজ করুন। রিকশাটা নিয়ে শিবগঙ্গা ঘাট চলে যান। ওখানে বাজারে একটা দোকান আছে ‘ইন্ডিয়ান গেম হাউস’ বলে। সেখানকার মালিক নরেন পালোধি আমার শালা হয়। বলবেন আমি পাঠিয়েছি, ভালো দাম দেবে দাদা। ওদের কাছে এসব দাবা-ক্যারাম-ব্যাগাটেলি আছে।”
শিবগঙ্গা ঘাটে যখন পশুপতি নামলেন তখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। মন্দিরে একটু পরে আরতি শুরু হবে, দলে দলে লোক সেদিকে যাচ্ছে। এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে পশুপতি পুরো বাজারটাই প্রায় ঘুরে ফেললেন। কোথায় ‘ইন্ডিয়ান গেম হাউস’? একটা ধূপের দোকানে জিজ্ঞেস করায় তারা রাস্তাটা দেখিয়ে দিল, একগাদা চুড়ির স্টলের মাঝখানে। দোকানটা দেখে হতাশ হলেন পশুপতি, ঝাঁপ বন্ধ। মস্ত একটা পেতলের তালা ঝুলছে। আশপাশে জিজ্ঞেস করে জানলেন, বৃহস্পতিবার ঝড়জলের জন্য নাকি দোকানের মালিক মাল আনতে যেতে পারেন নি। আজ গিয়েছেন। ফিরতে কাল বেলা হয়ে যাবে, তাই দোকান বন্ধ। হতাশ হয়ে একঠোঙা জিলিপি কিনে পশুপতি মন্দিরের সামনের ঘাটের সিঁড়িতে এসে বসলেন।
“কি ঝড়টাই না গেল মশাই!”
চেনা গলায় অবাক হয়ে চমকে পিছন ফিরে পশুপতি দেখলেন, সেই বিপ্লব মল্লিক। আজ তার গায়ে একটা কালচে রঙের ফুটবলের শার্ট, পরনে পাজামা। লোকটা বোধহয় হাঁটতে বেরিয়েছিল, অথবা আরতি দেখতে এসেছে।
“কি খবর আপনার? সব ঠিকঠাক তো?”
অচেনা লোক বলে তেমন পাত্তা দিলেন না পশুপতি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, “ওই চলে যাচ্ছে।”
লোকটা দুধাপ নেমে সিঁড়ির ওপর বসে পড়তে পড়তে বলল, “ওইটে হল ডাহা বাজে কথা। জিনিসের দাম দিন দিন বাড়ছে, মানুষ মরে উবে যাচ্ছে, সরকার দেখেও দেখছে না। এরমধ্যে ভালো থাকা কি যায়? তা এদিকে কি মনে করে?”
লোকটা গায়ে পড়া বটে। পশুপতি এবার বললেন, “একটা দাবার বোর্ড কিনতে এসেছি এখানে। পেলাম না, দোকান বন্ধ। কাল ছুটির দিন বলে বসে আছি। আরতি হয়ে গেলে বাড়ির দিকে রওনা দেব। আপনি?”
“আমি তো এইদিকেই থাকি মশাই।”
“ভাড়া থাকেন নাকি?”
“নাঃ,” বলে লোকটা হেসে জলের দিকে চেয়ে রইল। পশুপতি ভাবলেন, হয়ত নতুন বাড়ি কিনে এসেছে। বা বলতে চায় না। যাক গে, আদার ব্যাপারির জাহাজের খোঁজে কি দরকার? জিলিপিগুলো শেষ হয়ে এসেছিল এর মধ্যে। পশুপতি উঠবার উপক্রম করে বললেন, “আমি আজ তাহলে আসি? আবার দেখা হবে।” বিপ্লব মল্লিক ব্যাস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “আরে না না দাদা, এখনই কি? এই তো সবে সাড়ে ছটা বাজল। আসুন না একদান দাবা খেলি। আপনার নিশ্চয়ই ক’দিন উপোষ যাচ্ছে? নতুন বোর্ড কিনছেন যখন। আসুন আসুন ওইদিকটা যাই। ওদিকে আমার একটা ঠেক আছে। একহাত হয়ে যাক, সাতটার দিকে মন্দিরে পায়েস দেবে। খেয়ে দেয়ে একবারে ফিরবেন।” বলে ঘাটের সোজা হাঁটা রাস্তাটা দেখাল। আধ ঘণ্টা? একহাত দাবা? পশুপতি এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “বিপ্লববাবু আধ ঘণ্টায় খেলা হয়ত শেষ হবে না। আর আমার একটু তাড়া আছে, আজ আমায় মাপ করবেন। পরে এক সময় নিশ্চয়ই বসব।” বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। পেছন থেকে বিপ্লব মল্লিক আবার বলল, “ভেবে দেখুন, খেলা দশ মিনিটেও শেষ হয়ে যেতে পারে।” মহা পাজি লোক তো? পশুপতি ফিরে দাঁড়ালেন; নাঃ! এর দৌড় কদ্দুর এবার দেখা দরকার। খেলায় জিতলে মুখের ওপর বলে দেবেন আর বিরক্ত না করতে। পরেশবাবু যদি কোনমতে জানতে পারেন তাঁর প্রাক্তন ভাড়াটের সাথে পশুপতির দহরম মহরম চলছে, ভগবান জানে তিনি আবার কোন মূর্তি ধরবেন। খালি ঠোঙাটা ফেলে দিয়ে পশুপতি এবার বললেন, “তাই নাকি? চলুন তাহলে, আপনার ঠেক দেখে আসি।”
লোকটা বিগলিত হেসে উঠে এল। পকেট থেকে একটা চিরুনি বের করে চুলগুলো আবার পেতে আঁচড়াল। তারপর বলল, “আসুন”।
মিনিট দুয়েক হেঁটে একটা শনিমন্দিরের সামনের ধাপে এসে বসলেন পশুপতিরা। মন্দিরটা ছোট্ট, ভেতরে একটা শনিমূর্তি আর একটা রক্ষাকালীর মূর্তি। কেউ মনে হয় একটা ধুনুচিতে ধুনো জ্বেলে দিয়েছে, বাতাসে ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ। দূর থেকে আরতির শব্দ মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে। মন্দিরে প্রদীপ জ্বলছে, পেছনেই ল্যাম্পপোস্টের আলো স্পটলাইটের মত এসে পড়েছে চৌকো চাতালটায়। মন্দিরের পেছনে একটা খুপরি থেকে একটা ঘুঁটির বাক্স আর একটা লুডোর ছক্কা বের করে বিপ্লব বলল, “এখানে আমি বিকেলের দিকে আসি। এই মন্দিরটায় যে পুজো করে তার সাথে খেলি। বড় ভালো হাত মশাই। তা ঠাকুরমশাই আজ তিনদিন বেশ অসুস্থ, তাই আমারও খেলা হয় নি। আপনাকে দেখেই বুঝলেন না, হাতটা একেবারে নিশপিশ করে উঠল।”, বলে চাতালের চৌকো কাপড়টা সরাল সে।
পশুপতি দেখলেন, সেখানে পাথর বসিয়ে অবিকল একটা দাবার ছক করা। বেড়ে বোর্ড তো! আপনমনে একটু হেসে আঙুলগুলো মটকে পশুপতি দাবার ছক সাজাতে লাগলেন। ঘুঁটিগুলো বেশ পুরনো, এবং কাঠের তৈরি। কালো মন্ত্রীটা বসাতে গিয়ে পশুপতি দেখলেন, সেটার নিচে কালি দিয়ে ‘ব’ লেখা। দেখেই তাঁর মনে পড়ে গেল নিজের ছকের মন্ত্রীটার কথা। জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা বিপ্লববাবু, পরেশবাবুর বাড়িতে কি আপনার দাবার ঘুঁটি ফেলে এসেছেন কোন?” বিপ্লব মল্লিক একটু হাঁ করে বলল, “কই না তো? পরেশবুড়ো বলেছে বুঝি? লোকটা মহা জোচ্চোর কিন্তু। আমার বাসনপত্র আর স্টোভটা আটকে রেখেছে এখনও। বলে কি না মামলা কর। কিন্তু দাবার ঘুঁটি আমি ফেলে আসি নি,” বলে ঠোঁটের কোণে একটু হাসল। মন্দিরের আলোয় তার কামানো গাল আর হলদে দাঁত দেখতে পেলেন পশুপতি। ঘুঁটি সাজানো শেষ হতে বিপ্লব মল্লিক সেই ছক্কাটা পশুপতির হাতে দিয়ে বলল, “নিন চালুন।” কি করতে হবে বুঝতে না পারাতে সে বুঝিয়ে বলল, “জোড় সংখ্যা এলে আপনার সাদা, আর বেজোড় এলে কালো। ওই সাহেবদের মত টস করে পোষায় না মশাই।” পশুপতি ব্যাপারটায় বেশ আমোদ পেলেন। হাতে নিয়ে নাচাতে নাচাতে এক সময় ছক্কাটা চাতালে ফেললেন তিনি। ছক্কাটা বেশ বড় এবং কালো, মাঝখানে লাল লাল ফোঁটা। হাতে নিয়ে কোন কারণে পশুপতির একবার মনে হয়েছিল এই ছক্কা আর তাঁর দাবার বোর্ডের ঘুঁটিদুটো একই জিনিসে তৈরি। মসৃণ, শক্ত, আর ঠাণ্ডা। তিন পড়ল। বিপ্লব মল্লিক তুড়ি বাজিয়ে বলল, “আপনার তাহলে কালো।”
পশুপতি মনে মনে সাদা গুটি পছন্দ করেন। “বেস্ট অফ থ্রি,” বলে আবার ছক্কা ঘোরালেন তিনি। এবার এল পাঁচ। বিপ্লব মল্লিক হালকা গলায় হেসে বলল, “বার বার তিনবার। বড় ঠাকুরের পায়ে একটু ঠেকিয়ে নিন মশাই।” বিরক্ত মুখে পশুপতি আবার ছক্কা ঘোরালেন। এক! এবার আর পিছোলে লোকটাই বা কি ভাববে তাঁকে? বিপ্লব আবার সেই ঠোঁটের কোণে হাসিটা টেনে বললেন, “আহা! নিন আপনিই সাদা নিন। এত কসরতে লাভ নেই।”
লোকটা কি তাঁকে ছেলেমানুষ ভাবছে নাকি? গম্ভীর মুখে অফার নাকচ করে পশুপতি খেলতে বসলেন। মনে মনে বললেন, “বাছা, এই চৌষট্টি ঘর থেকে আগে বেঁচে বেরও তো…”। খেলা আরম্ভ হল।
কিছুক্ষণেই পশুপতি বুঝলেন, লোকটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও ধড়িবাজ। তিন তিন বার তাঁর আক্রমণের প্ল্যান বাঞ্চাল করে দিল ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে। গুটি যে বিশেষ কাটা পড়ল তা নয়, তবে দুজনেই অভিজ্ঞ দাবাড়ু। একে অপরের চাল আন্দাজ করতে করতে খেলতে লাগলেন। দশ মিনিটের মাথায় পশুপতির মাথায় জীবনে প্রথমবার হাত পড়ল। তাঁর মন্ত্রী উড়ে গেল বিপ্লবের নৌকোর ছাঁটে। গজ দুখানারও একই দশা। এ কি অদ্ভুতুড়ে খেলারে বাবা! লোকটা এত দ্রুত চাল ফেলতে লাগলো যে পশুপতি খেয়ালই রাখতে পারলেন না কোন ঘুঁটি কোনদিনে যাচ্ছে। তাঁর পরিষ্কার মনে হল বোড়েগুলো নিজেরাই এগিয়ে আসছে পশুপতির লঙ্কা-দহন করতে। আর মিনিট পাঁচেক চলার পর মান-সম্মান নষ্ট হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে লাগল। ঠিক সেই সময় দূরে মন্দিরে আরতি শেষের ঘণ্টা বেজে উঠল। পশুপতি হার মেনে হাত তুলে নিলেন ছক থেকে। সম্ভ্রমের চোখে বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি তো জাত খেলোয়াড় মশাই! আমি এরকম স্ট্রাটেজি কোনদিন দেখি নি। কোত্থেকে শিখলেন এসব?”
বিপ্লব মল্লিক মন্দিরের চাতাল থেকে একটা পয়সা তুলে প্রণাম করে পকেটে ভরে বলল, “সবই তেনার কৃপা। ওই যে ঠাকুরমশায়ের কথা বললুম, উনি শিখিয়েছেন। আপনি শিখবেন?” পশুপতি বললেন, “আলবাত! আপনি শেখালেই শিখব।”
“বেশ তো। একদিন সন্ধেবেলা আপনার বাড়িতে আড্ডা হয়ে যাক তাহলে।”
এবার ধন্দে পড়ে গেলেন পশুপতি। পরেশবাবুর মেজাজের কথা আবার মাথাচাড়া দিল। বিপ্লব মল্লিক হেসে বলল, “বুড়োর কথা ভাবছেন? ধুর! আপনি নতুন উঠেছেন তাই জানেন না। বুড়ো প্রতি দু’মাসের শেষ শনি রবি পাটনা যায় শ্বশুর বাড়ি। পুরো সপ্তাহ কাটিয়ে ফেরে। আসছে শুক্রবার ঠিক পগার পার হয়ে যাবে দেখবেন। আর ওই ছগনা, সে তো সন্ধে হলেই ভাগীরামের দোকানে বসে গাঁজা টেনে গিয়ে ঘুমোয়। আমি চলে আসব ঠিক, আপনি ভাববেন না।”
পশুপতি অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন বিপ্লব মল্লিকের দিকে। ল্যাম্পপোস্টের আলোটা হঠাৎ দপদপ করে উঠল। বিপ্লবের চোখটা যেন পাথরের তৈরি। ঠোঁটের কোণের সেই হাসিটা টেনে এনে সে আবার বলল, “আমিও তো ও বাড়িতেই থাকতুম মশাই। ঘাঁতঘোঁত সব জানা আছে। আপনি শুধু খিড়কির দরজাটা একটু খেয়াল রাখবেন, আমি ওই সাতটার পরে গিয়ে টোকা দেব,” বলে উঠে পড়ল সে। পশুপতি ডেকে বললেন, “বিপ্লববাবু, মন্দির যাবেন না পায়েস খেতে?” বিপ্লব মল্লিক হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আরে ধোপা উঠে যাবে আমার। ভুলেই গেছি যে শার্টটা দিয়ে এসেছি তাকে। পায়েস পরে আর একদিন হবে নাহয়। আপনি ঘুঁটিগুলো আর ছক্কাটা একটু তুলে রেখে দিন।” লোকটা মিলিয়ে গেল দূরে একটা গলির মধ্যে। পশুপতি ঘুঁটি তুলতে তুলতে গুণে দেখলেন; সাদাকালো মিলিয়ে আটটা বোড়ে, তাঁর সাধের কালো মন্ত্রী, তিনটে গজ, একটা সাদা নৌকো আর একটা কালো ঘোড়া কাটা পড়েছে।
৫
নাওয়া-খাওয়া-অফিস সব মাথায় উঠেছে পশুপতির। মোহগ্রস্তের মত হয়ে গিয়েছেন তিনি বিপ্লব মল্লিকের কাছে হারার পর। পরদিনই বেলায় গিয়ে একটা দাবার বোর্ড কিনে এনেছেন সেই ‘ইন্ডিয়ান গেম হাউস’ থেকে। সাধারণ প্লাস্টিকের বোর্ড, প্লাস্টিকের ঘুঁটি। শনি মন্দিরের চাতালেও গিয়েছিলেন তারপর। একটা ছোকরা পুরোহিত প্যান্টের ওপর নামাবলী পরে একটি অল্পবয়সী মেয়ের হাত দেখার নাম করে মশকরা করছে বসে। পশুপতিকে দেখে দাঁড়িয়ে বলল, “জি?” এ যে সে লোক নয়, তা ছেলেটার মুখ দেখলেই বোঝা যায়। মন্দিরের পেছনের ফোকরটাও উঁকি মেরে দেখলেন তিনি, কিছুই নেই। একটা খালি ফুলের ডালি রাখা কেবল। ফের নিচে নেমে হিন্দিতে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “বিপ্লব মল্লিককে চেন? সন্ধেবেলা এখানে এসে দাবা খেলে?” ছেলেটি সবিনয়ে জানালো সে কাছাকাছি থাকে না। তার বাড়ি এখান থেকে কুড়ি মাইল দূরে একটি গ্রামে। সকালে বাসে করে এসে সে এই মন্দিরে এবং বাবার মন্দিরে পুজোর কাজ করে এবং চারটের মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। তারপরের খবর সে কিছু জানে না। দরকার হলে পশুপতি মন্দিরের অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। মন্দিরের অফিসে গিয়েছিলেন তিনি, তবে সেখানেও কেউ বিপ্লব মল্লিক বা সন্ধের সেই ঠাকুরমশাইয়ের কোন হদিশ বলতে পারল না।
নিজের পুরনো দাবার বোর্ড, ঘুঁটি কিছুই খুঁজে পান নি আর তার পরে পশুপতি। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে খুঁজতে আর তাঁর ইচ্ছেও করে নি তেমন। মাথায় ঘুরছে কেবল সেই মন্দিরের চাতাল আর দাবার চাল। রাখালকে সোমবার সকালে অফিসের সামনে ধরে একটা ছুটির দরখাস্ত ধরিয়ে দিয়ে এসেছেন। বলেছেন হেডঅফিসে যেন একটু জানিয়ে দেওয়া হয় যে তাঁর পায়ের ফোস্কাটা সেপটিক হয়ে গেছে, এক সপ্তাহের জন্য তিনি ছুটি নিলেন। এত বছর চাকরি করে অনেক ছুটি জমা হয়েছে তাঁর, কোন অসুবিধেই হবে না। সব ভুলে এখন আপন মনে সাজিয়ে চলেছেন একের পর এক দান। হারাতেই হবে এই বিপ্লব মল্লিককে, নাহলে মান থাকবে না; এই ধারণাটা যেন কেউ সেই জংধরা ব্লেডটা দিয়ে কেটে বসিয়ে দিয়েছে পশুপতির মাথায়। পাঁচ দিনের অক্লান্ত চেষ্টার পর অবশেষে তার ফল মিলল। না। তাঁর সহজাত Blitz Chess খেললে হবে না এই পাজি লোকটার সাথে। আস্তে আস্তে ফাঁসিয়ে নিয়ে আসতে হবে পশুপতির এই চক্রব্যূহের মধ্যে। সিসিলিয়ান ডিফেন্স আর তাঁর নিজের দান মিশিয়ে বানানো এই অব্যর্থ মারণাস্ত্র। পশুপতির চাল।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পশুপতি আবার বসলেন দাবার ছক পেতে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠে ঘড়ি দেখলেন। সাড়ে তিনটে বাজে। দরজা খুলে দিতেই পরেশবাবু দু’পা পিছিয়ে গেলেন। “কি গন্ধ মশাই ঘরে! এরকম খালপচা গন্ধ কোত্থেকে আমদানি করলেন? ঘরে কিছু মরেছে-টরেছে নাকি?” দরজা আটকে এক সপ্তাহের না কামানো দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে মধুর হেসে পশুপতি বললেন, “কিছু দরকার?” পরেশবাবু বোধহয় নিজের বাড়িতেই এমন ব্যাবহার খুব একটা পেয়ে আসেন নি। একটু কেশে গলা ঝাড়া দিয়ে বললেন, “আমি কাল স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে পাটনা যাব। ফিরতে ফিরতে সামনের শুক্রবার হবে। ছগন বাড়িতেই থাকবে।” পশুপতি আগের মতই মধুর হেসে বললেন, “আচ্ছা।” পরেশবাবু দোতলায় উঠতে উঠতে বললেন, “আপনার ভাবসাব ভালো লাগছে না মশাই। এক হপ্তা ধরে দরজা এঁটে বসে আছেন। অফিস-কাছারি যান নি। এসে যদি দেখি কোন বেগরবাই হয়েছে তাহলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।” পশুপতি দরজা বন্ধ করে আবার ভেতরে এসে বসলেন। চুলোয় যাক পরেশ দত্ত আর তার বাড়ি। বিপ্লব মল্লিকের শিক্ষা হওয়াটা আগে দরকার। সেদিনের সেই খেলার চালগুলো কিছু কিছু মনে ছিল তাঁর। চেষ্টা করে সেগুলো বসিয়ে বসিয়ে দেখলেন বোর্ডে। নাহ, তাঁর চালের সামনে আর এসব জারিজুরি খাটবে না লোকটার। প্রথম প্রথম তার হয়ত মনে হবে সে জিতছে, কিন্তু যতক্ষণে বুঝতে পারবে ফাঁদে পা দিয়েছে, ততক্ষণে পশুপতির চালে সে একেবারে জড়িয়ে পড়বে। তারপর? পশুপতি বহু বছর পর একটা বোড়ে নিয়ে নাচাতে লাগলেন।
শুক্রবার সকালে বাথরুমে গিয়ে ভালো করে স্নান করলেন পশুপতি। দাড়ি কামালেন, ভালোভাবে নিমের ডাল দিয়ে রগড়ে রগড়ে দাঁতন করলেন। কুকারে খিচুড়ি বসিয়ে ছগনের হাতে পয়সা দিয়ে এক প্যাকেট দুধ আর চা-পাতা আনালেন। বিকেলের রসদ এটা। ঘরে সেই ঘাটের দোকান থেকে কিনে আনা ধূপ জ্বালিয়ে একটু বাতাস হালকা করলেন। মনে মনে ভাবলেন, একটা মালাও আনাবেন। বিপ্লব মল্লিক হারার পর তার গলায় মালাটা পরিয়ে বলবেন, যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মান তারই প্রাপ্য। তারপর মনে হল ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। পরেশবাবু দুপুরের ট্রেনে সস্ত্রীক পাটনা গেলেন। যাওয়ার আগে পশুপতির সেই আগের চেহারা দেখে বিশেষ কিছু বললেন না, তবে খালি বাড়িতে থেকে পুরুষমানুষেরা কি ধরণের কুকর্ম করে ও তার জন্য তিনি কতটা প্রস্তুত সে ব্যপারে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে পিঠটান দিলেন। বিকেলের দিকে পশুপতি ছগনের হাতে একটা পঞ্চাশটাকার নোট গুঁজে বললেন, সন্ধেবেলা যেন সে সদর দরজা বন্ধ করে চলে যায়, তাঁর এক বন্ধু আসার কথা আছে। ছগন কি বুঝল কে জানে? টাকাটা পকেটে ফেলে সে সিঁড়ির তলা থেকে ঘাস তুলতে লাগলো।
ঠিক সন্ধ্যা সাতটার সময় চায়ের জল বসালেন পশুপতি। বারান্দায় আলো জ্বেলে ছগন গেছে ভাগীরামের দোকানে, বাড়ি খালি। খিড়কির দরজাটা খুলে ভেতর থেকে ছিটকিনিটা দিয়ে রেখেছেন কেবল। সদর দরজায় তালা। চা গরম করে ফ্লাসে ঢালতে ঢালতে খিড়কির দরজায় টোকা পড়ল। খিড়কির দিকের ল্যাম্পপোস্টের আলোটা আজ সপ্তাহখানেক হল কেটে গিয়েছে। পৌরসভার লোক বড়রাস্তার খানা সারায় না, গলির বাল্ব বদলাবে এরকম আশা পাগলেও করবে না আজকালকার বাজারে। পশুপতি দরজা খুলে দেখলেন আবছা অন্ধকারে ঘষা পুরনো একটা ছবির মত বিপ্লব মল্লিক দাঁড়িয়ে আছে।
“আসুন, আসুন,” বলে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন তিনি। বিপ্লব মল্লিক হাসিমুখে বাড়ি ঢুকল। গায়ে সেই প্রথমদিনের রং ওঠা জামা আর প্যান্ট, কনুই অবধি হাতা নামানো। কলার থেকে বোতাম আঁটা। আজ তার হাতে তার একটা সাদা প্লাস্টিকের থলে, আর একটা বিড়ির বান্ডিল। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে সেই স্টোররুমের দরজার সামনে এসে বিপ্লব দাঁড়াল। পকেট থেকে একটা পয়সা বের করে দরজার সামনে মেঝেতে রাখল। তারপর পশুপতির দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, “মা লক্ষ্মীর প্রণামী।” মা লক্ষ্মী, অর্থাৎ বাসন ও স্টোভ। ঘরে ঢুকেই বিপ্লব বলল, “বাঃ! এ তো একেবারে আমার ঘরের মতই সাজানো। আমিও এভাবেই বসতুম ঘরের মাঝখানে টেবিল পেতে। আমার সাথে খেলতে আসতেন…” বলে হঠাৎ চুপ করে গেল সে। পশুপতি বুঝলেন বেচারা আগের জীবনের মায়া কাটিয়ে উঠতে পারে নি। হয়ত এখন আবার ঘাটশিলা ক্লাবে ফিরে গেলে তাঁরও একই দশা হবে। মুখে বললেন, “আরে আপনারই ঘর বিপ্লববাবু, বসুন না।”
বিপ্লব মল্লিক মুখের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, “না পশুপতিবাবু, আমার ঘর আর নয়। সে যাক গে, জালনাটা খুলে দেই একটু? হাওয়া আসুক? তারপর চা বিড়ি নিয়ে জাঁকিয়ে বসা যাবে।” বলে জানালার দিকে এগল। পশুপতি নিজের নতুন কেনা বোর্ড আর ঘুঁটি সাজাতে লাগলেন টেবিলে।
“আরে ও কি মশাই! আপনি আমার সাথে খেলবেন, এতদিন পর এ বাড়িতে আসা, এসব আলটপকা বোর্ডে খেলা ভালো জমবে না। আমার বোর্ডে খেলুন,” বলে প্লাস্টিকের ব্যাগটা দেখায় বিপ্লব। ব্যাগটা খুলতেই সেই খালের গন্ধটা আবার নাকে আসতে শুরু করেছে পশুপতির। ভেতরে বোর্ড নেই। একটা বাক্সে সেই কাঠের ঘুঁটিগুলো, আর একটা কাপড়ের ছক। ছকটা রুমালের মত পাতা যায়। দেখলেই বোঝা যায় সেটা বেশ পুরনো। ছকটা মেলে ধরলেন পশুপতি। সাধারণ দাবার ছক নয় সেটা। দু’পাশের ঘুঁটি সাজাবার ষোলটা ঘরে কোন ঘরে কি ঘুঁটি বসবে বাংলায় লেখা। ভারি অদ্ভুত দেখতে। সব মিলিয়ে কাপড়টায় কেমন যেন একটা হলদে হলদে ছোপ। ঠিক মাঝখানে একটা ঠাকুরের মুখ অস্পষ্টভাবে আঁকা, অনেক পুরনো, তাই আবছা হয়ে গেছে। পশুপতি অনেক দেখেও কোন ঠাকুর বুঝতে পারলেন না, তাঁর কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো।
“কি মশাই, সাজান?” বলে বিপ্লব দু’কাপ চা নিয়ে এসে বসল চেয়ারে।
“এই ছকটা কোত্থেকে পেয়েছেন?”
“আরে বলব দাদা বলব। বলতেই তো আসা। গল্প বলব, দান শেখাব, তারপর আমার ছুটি।” বলে আবার ঠোঁটের কোণে সেই মার্কামারা হাসিটা টেনে আনে বিপ্লব, “আপনি ঘুঁটি সাজান।”
ঘুঁটি সাজানো হয়ে গেলে বিপ্লব পকেট থেকে সেই ছক্কাটা আবার বের করে বলল, “আজ আমি চালি, কেমন? আগেরবার আপনি কালো পেয়েছিলেন, দেখি আজ আপনাকে সাদা দেয়া যায় কি না।” বলে ঘুরিয়ে দিল ছক্কা টেবিলের ওপরে। পাঁচ! বিপ্লব হাসিমুখে ছক্কাটা টেবিলের ওপর রেখে বলল, “চালুন”।
আঙুল মটকে সাধারণ ‘কিং-স পন ওপেনিং’, অর্থাৎ রাজার পেয়াদা দিয়ে খেলা শুরু করলেন পশুপতি। এবার লোকটাকে একটু অন্যমনস্ক করতে হবে। এ খেলা শুধু ছকে নয়, দুজনের মনের মধ্যেও চলবে। আজ যতরকম প্ল্যান তিনি এতদিন ধরে করেছেন, সব একে একে প্রয়োগ করবেন বিপ্লব মল্লিকের ওপর। বিপ্লবেরও যেন তাড়া নেই। আরাম করে সন্ধ্যের হাওয়া আর ধূপের গন্ধ উপভোগ করতে করতে শব্দ করে চা খাচ্ছে সে। অবহেলাভরে একটা আঙুল দিয়ে সে তার বোড়ে এগিয়ে দিল।
“বলছিলেন না, বলবেন এই ছকটা আপনি কোথায় পেলেন?”
“বলব। নিশ্চয়ই বলব। তবে আগে আমার কথা আপনাকে একটু জানিয়ে দি। আমার নাম বিপ্লব কুমার মল্লিক, বাড়ি ছিল মেদিনীপুর। আগে একটা ইন্স্যুরেন্স কম্পানির এজেন্ট ছিলাম। তো সেই কাজে আমায় নানা জায়গায় ঘুরতে হত। একবার এসবের চক্করেই গিয়ে পড়লাম একেবারে পানাগড়ে। পানাগড় চেনেন তো? হ্যাঁ, তো সেই পানাগড়ে আমার এক শাঁসাল মক্কেল ছিল। সে হঠাৎ চন্দ্রবিন্দু হয়ে যাওয়ায় পত্রপাঠ যেতে হল। এসব কেস হল বড়লোক বাড়ির কেস, অনেক সময় বাড়ির লোকই পয়সার লোভে বাড়ির লোককে পরপারে পাঠিয়ে দেয়, হে হে। ইন্স্যুরেন্সের বাজার হয়ে মানুষের জীবন আরও সস্তা হয়ে গেল মশাই।”
বিপ্লবের অলক্ষ্যে তার একটা বোড়ে কেটে ফেললেন পশুপতি। কফিনের প্রথম পেরেক এটা। বিপ্লব যেন সেটা দেখেও দেখল না। আরাম করে চা খেতে খেতে বলে চলল।
“তো সেখানে কোম্পানি আমায় পাঠাল তদারক করতে, যে মৃত্যু স্বাভাবিক কি না। তা আমি কি আর ডাক্তার নাকি মশাই, জিজ্ঞাসাবাদ করে যতদূর বোঝা যায় চেষ্টা করব, এরকম ভেবেই পাড়ি জমালুম। আমাদের কাজে এসব আকছার হয়ে থাকে, তাই আপত্তি করলুম না। বলব কি মশাই, এমন কপাল যে বর্ধমানের আগেই গাড়িটা বসে গেল। আর আমিও গিয়ে আটকালাম একেবারে মাঝমাঠে। সেই ভুশণ্ডির মাঠের মত। হে হে! দাঁড়ান তো আপনার ঘোড়াটা…” বলে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল ছকের দিকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ খেলা চলার পর আবার কয়েকটা ঘুঁটি কাটা পড়ল দু’পক্ষের। তারপর আবার এক কাপ করে চা নিয়ে এলেন পশুপতি। মনে মনে খুশী হলেন। সামান্য অদল বদল হলেও সেদিনের খেলার সাথে তফাৎ নেই তেমন বিপ্লবের চালগুলোর। আর একটু ঢুকে এস বাছাধন, তারপর শুরু হবে খেল।
দ্বিতীয় কাপ চা নিয়ে ফের গল্প শুরু করল বিপ্লব, তার চোখ এবার ছকের দিকে একদৃষ্টে নিবদ্ধ।
“তো সেই মাঠের মাঝখানে সন্ধের মুখে গাড়ির বনেট খুলে দেখলাম যে স্পারকিং প্লাগটা কাজ করছে না আর। অথচ সেটা হওয়ার কথাই ছিল না। সকালে আমি গাড়ি খুলে দেখেছি। স্টার্ট করেছি। তেল মোবিল সব পাল্টেছি, তাহলে এরকম কেন হল? যাক গে, সেসব এখন আর ভেবে কাজ নেই। হিসেব মত আর মাইলতিনেক দূরে একটা গঞ্জ মত পড়ার কথা ছিল। সেখানে পৌঁছে গ্যারেজে দেখাবো বলে ঠেলতে শুরু করলুম। তখন বাজে সন্ধে পৌনে সাতটা। একটু দাঁড়িয়ে একটু ঠেলে যখন সাড়ে দশটার মধ্যেও যখন একটা সাইকেল, কি মাইরি একটা কুকুরও দেখতে পেলুম না, তখন বুঝলুম যে রাস্তা ভুল করেছি কোথাও। আসলে ওদিকে অনেকদিন আসা হয়নি বলে কোথাও গণ্ডগোল হয়ে থাকবে।”
ওদিকে ছকে নিপুন শিল্পীর মত জাল বুনে চলেছেন পশুপতি। আহা! কিসব দানই না মাথায় আসছে তাঁর। মাঝে একটা দুটো দান পালটেও দিলেন তিনি ভাবতে ভাবতে, যাকে বলে ইম্প্রভাইজেশান। বিপ্লব কিন্তু তার স্বভাবসিদ্ধ সেই মারাত্মক বিপজ্জনক সব চাল ক্রমাগত চেলে চলেছে। যত্ন করে দাঁত তোলার মত পশুপতির নৌকটা তুলে নিয়ে সে বলে চলল, “কোথায় যাই কোথায় যাই করতে করতে হঠাৎ দেখলুম একটা মস্ত বটগাছের নিচে একটা ভাঙা ছোট্ট ঠাকুরের মন্দির, এই আমাদের শনিমন্দিরের মত। অবিকল একই দেখতে, কেবল ল্যাম্পপোস্ট নেই। সেখানে বোধহয় ঠাকুরের পুজো সেরে ঠাকুরমশাই বেরতে যাচ্ছিলেন। ডেকে জিজ্ঞেস করলুম, গঞ্জটা কতদূরে। উত্তরে তিনি যা বললেন, তাতে বুঝলুম, আমার আশঙ্কাই ঠিক। রাস্তা ভুল হয়েছে। ঠাকুরমশাই বেশ রসিক মানুষ, বললেন বাবাই জুটিয়ে দিলেন তোমায় আর আমায় একসাথে। বস মন্দিরের কাছে। আমার ছেলে একটু আগে গঞ্জেই গেছে সাইকেলে, সে লরির মেকানিক। সে ফিরলে তোমার গাড়ি সারিয়ে দেবে এখন। ভাবলুম ভালোই হল। শরীরেও আর দিচ্ছে না। ঠিক হোক বা না হোক, গাড়িতেই ঘুমিয়ে সকালে যাব পানাগড়।”
“তো সেই মন্দিরের চাতালে দেখলুম এই ছকটা পেতে ঠাকুরমশাই দাবা খেলছিলেন। বোধহয় পুজো শেষ করে ছক গুটিয়ে বাড়ির দিকে যাবেন। গাছের গোড়ায় একটা ডোবামত দেখে সেখানে পা ধুতে যেমনি যাব অমনি ঠাকুরমশাই বললেন, ওখানে যেও না বাবা। বড্ড জোঁকের উৎপাৎ। মন্দিরে বালতিতে জল আছে সেখানে হাতমুখ ধোও। কি আমার বলিহারি জল রে! সে জলও বোধহয় সেই ডোবারই, তাতে পাতাপচা গন্ধ। যাকগে, মন্দিরে একটা পয়সা দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে একটা বাতাসা কামড়াতে কামড়াতে ছকটা দেখে ভারি অবাক হলাম। এরকম বাংলা দাবার ছক আমি বাপের জন্মে দেখি নি। ঠাকুরমশাইকে জিজ্ঞেস করলুম, ছকটা কোত্থেকে বাগালেন? ঠাকুরমশাই বললেন, সে তো এমনি বললে হবে না বাবা! আমার সঙ্গে একদান খেলতে হবে। আর যদি জেত পরে বলব। ভাবুন ঠ্যালা! একে তো গাড়ি খারাপ, তার ওপর এই রাত্তিরবেলা ডোবার ধারে দাবা! যেন ভূতের গল্প মশাই।”
এক কান খাড়া করে এতক্ষণ শুনছিলেন পশুপতি। খেলা খেলার মত চলছিল। প্রায় বেঁধে এনেছেন বিপ্লবকে তাঁর মায়াজালে। আর সাত-আট দান মাত্র, তারপরেই ফলাফল বুঝতে পারবে বিপ্লব মল্লিক। হঠাৎ সে চুপ করে যাওয়ায় তিনি সামনের দিকে চাইলেন। বিপ্লব তেমনই বসে আছে চেয়ারে। জানালাটা বন্ধ হল কখন? পশুপতি কি এতই তন্ময় ছিলেন নাকি যে একটা আস্ত মানুষ সামনে থেকে উঠে গিয়ে জানালা বন্ধ করে এল, আর তিনি আওয়াজ দৃশ্য দুটোই বেমালুম এড়িয়ে গেলেন? অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করল বিপ্লব, “আর কটা চাল বাকি?” নিজের অজান্তেই মুখ থেকে উত্তরটা বেরিয়ে এল পশুপতির, “আটটা।” আচমকা গলার আওয়াজ বদলে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল বিপ্লব মল্লিকের। সে বলেই চলল।
“বেশ। রসুন একটু। গল্পটা শেষ করে নেই। দাবা খেলতে আমি মোটেও পারতাম না পশুপতিবাবু, কোনদিন খেলিও নি। আমার নেশা ছিল ক্যারামের। ঠাকুরমশায়ের মুখোমুখি বসে সেই কথাই বলছিলুম। ঠাকুরমশাই শুনলেন না, বললেন তুমি ছক্কাটা হাতে নিয়ে চাল তো আগে। খেলা আপনি পারবে। জোড় পড়লে সাদা তোমার, বেজোড় পড়লে কালো। এই সেই ছক্কা। কিছু করার ছিল না, সময়ও কাটতে চায় না, কি জানি কি ভেবে বসে পড়লুম খেলতে। কালো জুটল কপালে। আশ্চর্য গুণ মশাই এ ছকের। বসতে না বসতেই মনে হল, এ ছক আমার চেনা। এই ঘুঁটিগুলো সব আমার চেনা। এগুলো যেন সব জ্যান্ত। দেখুন! দাবার ঘুঁটিগুলো দেখেছেন? কেমন মানুষের আঙুলের মত দেখতে, তাই না?”
ছকের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন পশুপতি। সত্যি এক একটা কাটা আঙুল বসানো ঘুঁটিগুলোর জায়গায়। সাদা-কালো-ফর্সা-লম্বা-মাঝারি, প্রত্যেকটা ঘুঁটি এক একটা জীবন্ত আঙুল। নড়ছে সেগুলো কিলবিল করে। গোড়ায় রক্তের দাগ স্পষ্ট, যেন এইমাত্র কেটে আনা হয়েছে। মাঝের ছবিটাও এবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। মা ছিন্নমস্তা। কেবল ছকের সেই আঙুলগুলো থেকে রক্ত বের হয়ে বেয়ে বেয়ে নিজে থেকে চলেছে সেই ছিন্নমস্তার ছিন্ন গলার দিকে। বিপ্লবের মুখ তখনও নির্বিকার। ঘরের বাতিটা এরকম আবছা হয়ে এল কি করে? পশুপতির প্রায় মূর্ছা যাওয়ার মত উপক্রম হল। বিপ্লবের মোটা গলা শুনতে পেলেন তিনি। গল্প এগিয়ে চলল।
“খেলায় আমি জিতে গেলুম সে রাতে পশুপতিবাবু। কিভাবে তা জানি না। এই ছক কোথা থেকে এল, কে বানিয়েছে, এই আঙ্গুলগুলো কাদের, তাও জানি না। জানি শুধু ওই ঠাকুরমশাইয়ের গল্প। তিনি এই ছকটা পেয়েছিলেন কোন এক মেলায় এক বাজিকরের কাছ থেকে। তার কাছ থেকেও এভাবেই খেলে এবং জিতে এই ছক তিনি হাতে পান। ঘুঁটি এবং ছক্কা, মানুষের হাড়ের তৈরি। সে হাড় কাদের, কত পুরনো, এই ছকের সাথে তাদের সম্পর্ক কি, তা আমার জানা নেই। খেলার শেষে ঠাকুরমশাই কেবল বলেছিলেন, যতদিন না আমি হারছি, ততদিন আমায় প্রতিদিন রাতে খেলতে হবে। হয় কারোর সাথে, নয় নিজের সাথে। নাহলে সেই ডোবার জল আমায় ডুবিয়ে মারবে। মেরেও শান্তি দেবে না। খুঁজতেই হবে কাউকে যার কাছে আমি হারব। বলে তিনি গিয়ে সেই ডোবার জলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। আপনার চাল।”
অনেক চেষ্টা করেও জ্ঞান হারাতে পারছেন না পশুপতি। বিপ্লবের হাতে যেন মায়াবলে সেই জংধরা ব্লেডটা উঠে এসেছে। একটা একটা করে কলার থেকে বোতাম খুলতে শুরু করল সে। গম্ভীর গলায় আবার বলল, “আপনার চাল।” এ গলা তার নয়, গলার সুর তার নয়, ঘরের কোন শব্দ তার নয়। যেন ছকের মায়ায় প্রাণ হারানো হাজার হাজার গলা একসাথে চিৎকার করে বলছে, “আপনার চাল! পশুপতি, আপনার চাল! আজ আপনিই জিতবেন! আজ আপনার জেতার রাত এসেছে অনেক অনেক বছর পরে।” মন্ত্রমুগ্ধের মত চাল দিলেন পশুপতি। এক! বিপ্লব ব্লেডটা ধরে আড়াআড়ি চালাল বুকের ওপর, রক্তের জায়গায় চামড়ার ওপর বিন্দু বিন্দু সবুজ জলের ফোঁটা ফুটে উঠতে লাগলো।
“তারপর থেকে আট বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি এই ছক আর এই ঘুঁটি। প্রতিদিন প্রতিরাত খেলতে হয়েছে আমায়। কখনও কারো সাথে, কখনও একা। এই যে ছগন, ভাগীরাম, এরা সবাই আমার সাথে খেলেছে। এই ছকেই। এই যেভাবে আপনি খেলছেন। কিন্তু কেউ জেতে নি তারা। অনেকেই জেতে নি। পরদিন সকালে লোকগুলো আবার সব ভুলে যায়। নিজের কাজে ফিরে যায়। স্বাভাবিক হয়ে যায়।”
পশুপতির আঙুল সরছে না ছকের ওপর থেকে। ওটা যেন টেবিলের ওপর ছেপে বসানো সেই মন্দিরের চাতালের মত। রক্তের ধারা টেবিলের পায়া বেয়ে পড়ছে মেঝেতে, আবার উঠে আসছে ছিন্নমস্তার গলার দিকে। কি ভয়াবহ! পশুপতি খেয়াল করলেন তাঁর সাদা আঙুলের ঘুঁটিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে পিষে মারছে কালো ঘুঁটিগুলোকে। ছকের বাইরে রাখা সাদা ঘুঁটিগুলো উল্লাসে আনন্দে লাফালাফি করছে আসন্ন জিতের আশায়। ছয়!
বিপ্লবের বুকে ছটা দাগ ব্লেডের। ঝরঝর করে পড়ছে সবুজ জল। পা ভিজে যাচ্ছে পশুপতির। ঘরে এখন প্রচণ্ড পচা গন্ধ খালের। মাথাটা দপদপ করছে তাঁর।
“তারপর আপনি এলেন। একটা ঘুঁটি কুড়িয়ে পেলেন। এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার আগে একটা ঘুঁটি আমিই সাজিয়ে রেখেছিলাম। আট বছরে এটুকু বুঝেছি যে ছক নিজের খেলোয়াড় নিজেই জোগাড় করে নেয়। জেতাতে চেষ্টা করে নিজের মায়াবলে তাকে। যাতে এই অভিশাপ বয়ে চলে যুগের পর যুগ ধরে। আমি কোনদিন দাবা খেলি নি, আমায় তাও ছক জিতিয়েছিল কেন তা আমি জানি না। আর আপনি? আপনি তো দাবারই গুণমুগ্ধ। আশা করি আপনার অসুবিধে হবে না।”
আট! বিপ্লব এবার গোল করে গলার চারদিকে ব্লেড চালিয়ে দিল। সবুজ জলের ধারা বেয়ে এল তার জামা বেয়ে। পশুপতির চালের শেষ দানটা তখনই পড়ল। চেক, এবং মেট।
৬
অনিমেশের জবানবন্দীঃ
"রাখালদা আমাদের অফিসে খবর পাঠানোর দু’সপ্তাহ পরেও যখন আমরা পশুদার কোন খবর পেলাম না, তখন বড়সাহেব আমায় আর বিনোদকে দেওঘর পাঠালেন। তো গিয়ে সেই খিটখিটে বুড়ো পরেশ দত্তর বাড়ি গিয়ে জানতে পারলুম তিনি নাকি পশুদাকে বের করে দিয়েছেন বাড়ি থেকে। অদ্ভুত লোক মশাই, চাকরটাও একটা গবেট। জিনিসপত্রগুলোও আটকে রেখে দিয়েছিল, ভয় দেখিয়ে সেসব আমরা কুড়িয়ে কাচিয়ে নিয়ে এসেছি। বাজারে আশেপাশে খোঁজ খবর করে জানলাম পশুদার মত দেখতে একটা লোক নাকি শিবগঙ্গার ঘাটে দাবার ছক পেতে বসে থাকে। সবাইকে খেলতে বলে, কেউ নাকি তার কাছে পাগল বলে ভেড়ে না। যাক গে, তো সেখানে গিয়ে দেখলাম যা ভেবেছি তাই। মাইরি, পশুদা যে এরকম বদ্ধ পাগল হয়ে যাবে আমরা ভাবি নি।
দাবার ছক আর গুটি, আর একটা কালো মত ছক্কা নিয়ে ঘাটে বসে ছিল। কে জানে কদ্দিন খায় দায় নি। মন্দিরের কাছে বলে লোকে তাও দুচার পয়সা, খাবার-টাবার দিয়ে গেছে, সেসব লোকটা ছোঁয় নি পর্যন্ত! যাক গে। সে আমাদের সাথে কিছুত্তেই আসবে না দাদা! পুরো নাছোড়বান্দা। অনেক কষ্টে পুলিশের সাহায্য নিয়ে তাকে রাঁচিতে ভর্তি করে তবে আমরা ফিরি।
কে? বিপ্লব মল্লিক? নামটা শুনেছি, ওই পশুদা নাকি মন্দিরের অফিসে খোঁজ করতে গিয়ে বলেছিল। পরে পুলিশ খানা তল্লাশ করেছে। ও নামে দেওঘরে কস্মিনকালেও কেউ ছিল না। জানি না কোত্থেকে নামটা জোগাড় করেছিল পশুদা।
মাঝে মাঝে আমরা দেখে আসি জানেন? আমাদের দেখলে চিনতে পারে। কোন পাগলামোও করে না। খালি বলে, এস একদান খেল। একটা নতুন দান শেখাব। আমার বানানো। আমরা দাবা আর খেলি না। পাগল নাকি! পশুদার মত একটা সুস্থ লোককে যে খেলা একেবারে বদ্ধ উন্মাদ করে দিল যাকে বলে, সে খেলা কেউ খেলে আর? আর সেই সেলে খেলবই বা কোথায়? সেলে তো কিছু নেই। লোকটা একা একা মেঝেতে বসে চাল দিয়ে চলেছে দিনরাত।
কি বললেন?
আপনি গল্প লেখেন?
এসব লিখবেন নাকি? আরে দাঁড়ান দাঁড়ান, নাম ধাম গুলো একটু বদলে দেবেন। হ্যাঁ হ্যাঁ উনি এখনও রাঁচিতে, এখন বয়েস হয়ে গেছে। সেল নাম্বারটা? মনে নেই, কিছু মনে করবেন না। নমস্কার।"
(শেষ)
© All rights reserved by Copyright Act 2020, Department of Art and Culture, Government of India
Copyright Office, New Delhi 110025

Comments