top of page

নেইবাড়িঃ পর্ব ২

Writer: অতিমানবঅতিমানব


সময় তখন কত বলতে পারব না, কারণ জেগে ওঠার পর এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, আমি আমার ঘরে নেই। এ জায়গা অন্য। আমি বসে আছি একটা চেয়ারে। পাশে একটা খোলা জানালা, সেখান দিয়ে বাইরের আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। রোদ বা চাঁদের আলো নয় সেটা, একটা হাল্কা হলুদ রঙের আবছায়া মত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে আমার চারপাশে। ঘষা লেন্সের মধ্যে দিয়ে দেখলে যেমন সবকিছু অস্পষ্ট মনে হয়, সেইভাবে দেখতে পাচ্ছি চারপাশটা। ঘরটা সরু আর লম্বা, বেশ হল ধরণের। আর কোন আসবাব দেখছি না এই চেয়ার বাদে, কোন দরজাও না। কেবল দেয়ালে একটা ফাঁকা ফটোর ফ্রেম ঝুলছে। অনুমান হয়, সেটা বেশ পুরনো। কি করে এখানে এলাম আর এই চেয়ারে বসেই বা আছি কেন, কিছুই মনে করতে পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে জানলার বাইরে তাকাতেই মাথা ঘুরে গেল এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে! এর আগে হোটেলের যে বাগান আর চার্চ দেখেছিলাম, যেন কতকটা তারই মত। কেবল সেই বাগানের সাথে এই দৃশ্যের তফাত এই, যে এখানে প্রতিটি গাছ মৃত। ছোট, বড় এমনকি ঘাসগুলো পর্যন্ত শুকিয়ে হলুদ হয়ে কুঁকড়ে আছে। মস্ত মস্ত গাছগুলো আগাগোড়া ন্যাড়া, শাখা-প্রশাখারা সুদূর বিস্তৃত। চার্চটা দেখে চেনা চেনা মনে হল, কিন্তু হোটেলে যেমন দেখেছিলাম, এ চার্চ যেন ঠিক তেমনটা নয়। কিছুটা যেন এগিয়ে এসেছে। আর আকারে আরও অনেক, অনেক বড়। মস্ত দরজাটা ফাঁক হয়ে আছে সামান্য। গম্বুজটার মাথায় যেন আগুন লেগেছে, এমন একটা হলুদ লাল হল্কা বের হচ্ছে। পিছনে যেখানে সমুদ্র আর বালুচরের মনোরম দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল, এখন সেখানে জেগে আছে কেবল একটা মস্ত হলুদ কুয়াশা।

এ যেন কোন গল্পের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আশা দৃশ্যের বর্ণনা! ঘাড় ফিরিয়ে পিছু হটতে গিয়ে দেখলাম, ঘরের দেওয়ালগুলো ক্রমে এগিয়ে আসছে আমার অলক্ষ্যেই। আমি তাকাতেই যেন থেমে গেল। হ্যাঁ! এই তো! চেয়ার থেকে হাত চারেক দূরে ছিল দেওয়ালটা, এখন প্রায় হাতলের কাছে। মাত্র আধহাত খানেক। হঠাৎ একটা সুরেলা শব্দ শুনে আবার সামনে তাকিয়ে জানলার দিকে ফিরে দেখলাম, সেই আগুনে চার্চের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে একটি লোক, হাতে তার ব্যাগপাইপ। একান্ত মনে মাথা নিচু করে সে ফুঁ দিয়ে চলেছে ব্যাগপাইপে। সে সুর অদ্ভুত মাদকতাময়; আরও অদ্ভুত সেই লোকটার এগিয়ে আসার ভঙ্গি। যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে সে হেলতে দুলতে ব্যাগপাইপ বাজানোর আর কুচকাওয়াজের ছন্দে। চার্চটা ক্রমে আরও বড় হয়ে উঠছে, খাটো হয়ে আসছে মাঠ। আর মাত্র দশ পা! কি তাও নয়! ব্যাগপাইপ হাতে লোকটা দেখতে দেখতে পৌঁছে গিয়েছে আমার জানালার কাছে। হঠাৎ ভয়ে আমার গায়ের সমস্ত রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠল। পালাতে হবে এখান থেকে এক্ষুনি! কানে কানে কেউ যেন বলে দিল, যে এগিয়ে আসছে সে আদৌ জাগতিক বাসিন্দা নয় কেউ। এই ঘর, এই চার্চ, সামনের এই বীভৎস ন্যাড়া গাছপালা, কোনটাই আমার চেনা পৃথিবীর নয়। আমি যেন বিনা অনুমতিতে এসে পড়েছি কোন অন্য জগতে, যেখানে আমার মত জীবিত প্রাণীর কোন অধিকার নেই । না না আর এক মুহূর্ত থাকা যায়না!

লোকটা এগিয়ে আসার সাথে সাথেই কি না জানি না, একটা পোড়া চামড়া-পচা গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো প্রায়! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে একটি ছায়ামূর্তি। মুখ তার পরিষ্কার বোঝা যায় না। কিন্তু দাঁড়াবার ভঙ্গিটা কোথায় যেন দেখেছি। দরজা ছাড়া এ এখানে ঢুকলই বা কি করে? মাথার মধ্যে সমস্ত গুলিয়ে যেতে লাগল। কোন এক অজ্ঞাত মায়াবলে হঠাৎ ঘরটা আর দেখতে পেলাম না। আমি দাঁড়িয়ে আছি সেই ন্যাড়া বাগানে। ব্যাগপাইপার হাতে সেই লোকটি সামনে এসে তার ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমার মুখের দিকে। মুখ তার তেমনই নামানো, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে অনর্গল নির্গত হচ্ছে এক মাথা ঝিমঝিম করা সুর। সভয়ে লক্ষ্য করলাম সেই লোকটির জামার ভেতর থেকে বুক চিরে যেন বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য অগুন্তি হাত। বাজিয়ে চলেছে তারা ব্যাগপাইপ।


“পাত্রোঁ! পাত্রোঁ!”

মৃদু দরজায় টোকা পড়ার শব্দে ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানার ওপর। আর উঠতেই চোখ পড়ল সেই ব্যাগপাইপারধারীর ছবির দিকে। কিন্তু তখন সব স্বাভাবিক। বুড়ো নিচু মাথায় স্মিত মুখে ব্যাগপাইপ বাজাচ্ছে হেলে দাঁড়িয়ে। জানালা দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত আলো এসে উজ্জ্বল করে রেখেছে টেবিলে রাখা পেপারওয়েটটা। কি সাংঘাতিক দুঃস্বপ্নে ডুবে গেছিলাম আমি! এ নিশ্চয়ই কাল রাতে বাসের দুলুনি আর এতক্ষণ না খাওয়ার ফল। ঘুমিয়ে উঠে ক্লান্তি অনেকটা কমেছে, সাথে টের পেলাম পেটে সুঁচ ফোটাবার মত খিদের চিনচিনে আভাষ। আবার মৃদু ডাক, “পাত্রোঁ!”

বোধহয় ডেভিডের গলা। বিছানা থেকে নেমে পড়ে দরজার দিকে যেতে যেতে একবার খোলা জানালার বাইরে চোখ চলে গেল। বিকেলের কমলা আলোতে ঘাসের মাথা যেন সবুজ কার্পেটের মত বিছিয়ে আছে। চার্চের গেটে একটা বাল্ব জ্বলে উঠেছে এখন। চার্চটা কি সামান্য সরে গেছে জানালার ডানদিকে? বাগানটা যেন একটু বেশী দেখা যাচ্ছে। না না এসব আমার মনের ভুল। বাড়ি আর গাছপালা কি ইচ্ছে করলেই জায়গা বদলায় নাকি? তবু অস্বস্তিটা গেল না। আমি দরজা না খুলেই হেঁকে সাড়া দিলাম, “হ্যাঁ বল ডেভিড।”

“গুড ইভনিং। চায়ের সময় হয়েছে। আপনি কি এখন আসবেন না একটু পরে?”

আমি বললাম, “না। তুমি প্লিজ আমার চা টা একটু ঘরে পাঠিয়ে দাও।”

ডেভিড কিছুক্ষণ চুপ করে রইল; তারপর বলল, “দুঃখিত। আপনাকে হলে আসতে হবে। আমাদের এখন এত স্টাফ নেই যে আপনাকে ঘরে এসে চা দিয়ে যেতে পারবে।” বলে সম্ভবত চলে গেল হলের দিকেই। বিটকেল এই হোটেলে জঙ্গলে ব্যাবসা খুললে স্টাফই বা থাকবে কোত্থেকে, মনে মনে ভেবে হাসলাম। অগত্যা বোধহয় হলেই যেতে হবে। উঠে পড়লাম এবার। মোবাইলটা তুলে দেখলাম, সেটা তখনও অকেজো। টাওয়ারের নাম গন্ধ এল না সারাদিনে! ঠিক করলাম, চা খাওয়া শেষ হলে থমাস ভদ্রলোকটির সাথে দেখা করে এবার লক্ষ্মীবাবুকে ফোনটা, থুরি, ট্রাঙ্ককলটা সেরে নিতে হবে। এতক্ষণ কোন খোঁজ খবর না পেয়ে শেষে যাওয়ার দিন বাসটা না বাতিল করে দেন তিনি। জামাকাপড় বদলে ঘরে তালা দিয়ে চললাম হলের দিকে। করিডোরের চারপাশে ইলেকট্রিক আলোগুলো জ্বলে উঠেছে এর মধ্যেই। হোটেলের বাকি ঘরগুলোর প্রত্যেকটা তালা দেওয়া। বোঝাই যায় কেউ নেই এখন। অকারণে আমার একবার গায়ে কাঁটা দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম, রিসেপশনেও আলো জ্বলছে, কাউন্টার খালি।

করিডোর যেখানে শেষ, সেখানে একটা ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে ডিনার হলের দরজা। বারান্দাটা ঠিক হল আর হোটেলের মাঝখানে একটা ব্রিজের মত, দুদিকে কাঠের সরু সরু থাম মাথায় একটা ছোট্ট তিনকোনা ছাদকে ঠেকিয়ে রেখেছে। এই বারান্দাটার কাছে এসে আমার হঠাৎ মনে হল, হোটেলটা কি একটু বেশী পুরনো লাগছে আগের থেকে? কাঠের মেঝেতে ধুলোর আস্তরণ তো এত স্পষ্ট ছিল না। এদিকের থামের গা বেয়ে উঠেছে জংলী লতার গাছ। তাতে হাল্কা গোলাপি রঙের ফুল। দেখে হঠাৎ মনে হল, যেন এই করিডোরে অনেকদিন কেউ হাঁটে না। সামনের পরিষ্কার ভাবটা যেন কোন কারণে বাড়ির ভেতর অবধি এসে পৌঁছয় না। ডিনার হলটা দেখা যাচ্ছে, ভেতরে হাল্কা বাল্বের রঙের আলো জ্বলছে করিডোরের মতই। আলো লক্ষ্য করে এগিয়ে বারান্দা পেরিয়ে এসে ঢুকলাম হলের ভেতর। আর ঢুকেই মনে হল, বোধহয় ভুল ঘরে এসেছি। এ ঘর কোনমতেই ডিনার হলের জন্য ব্যাবহার হয় না।

হল না বলে ব্যাপারটাকে একটা খাটো প্যাসেজ বললেই ভালো হয়। সার সার টেবিল, মাঝখান দিয়ে কোনমতে যাওয়ার মত সরু পথ করা। হলের আসবাব এবং বাসনপত্র যা সাজানো আছে টেবিলে, এত কম আলোতেও সেগুলো বেশ স্পষ্ট দেখাচ্ছে। আর দেখেই প্রথম যেটা মনে হয়, তা হল এগুল বেশ কয়েকমাস, বা তারও বেশী, এভাবেই পড়ে আছে। হলের দেয়ালে একটাই বড় ছবি লাগানো। রিসেপশনের মতই সেটাও সাদাকালো, আর পুরনো। কিন্তু রিসেপশনের ছবিগুলোর ওপর এরকম মাকড়সার জাল বোধহয় ছিল না। সেই আদ্যিকালের ক্যামেরায় তোলা অস্পষ্ট কিছু মুখশ্রী, কিছু অচেনা মানুষের জমায়েত এই হলে। সবগুলি টেবিল অতিথিতে ভর্তি। এটার তলায় লেখা আছে ‘ইস্টার ইভনিং ডিনার, ১৯৬৯’। টেবিলে বিভিন্ন দেশীয় সাহেব-মেম, এক কাফ্রি দম্পতি এবং কিছু ভারতীয় রহিস অতিথিদের ছবি। একপাশে দরজায় ঠেস দিয়ে একটি স্থূলকায় মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন রাঁধুনির পোশাক পরে, তাঁর হাতে একটা বড় হাতা বা খুন্তি জাতীয় কিছু ধরা, ঠিক যেমন ক্যাটারারের রাঁধুনিদের কাছে থাকে। পাশের উঁচু টুলে রাখা একটা বড় গামলা। ছবির একটা বৈশিষ্ট্য হল, সবাই ক্যামেরার দিকে চেয়ে আছে এমনভাবে, যে কিছুক্ষণ তাকালে মনে হয় তারা বুঝি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা ডিনার পার্টির ফটোগ্রাফ, কিন্তু কেন জানি না মনে হল ছবিটায় কোন অস্বাভাবিকত্ব আছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও সেটা ধরতে পারলাম না।

বোধহয় বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে ছিলাম ফটোর দিকে; খেয়াল করি নি এর মধ্যেই দিনের আলো আরও কমে সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। এক চিলতে সূর্যের আলো কোন ফাঁকফোকর দিয়ে এসে ফটোর ওপর পড়ছিল। সেটা এবার ক্রমশ কমতে কমতে এসে সেই রাঁধুনি মহিলার মুখের ওপর এসে স্থির হল। দেখলে মনে হয় একটা মড়াকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কেউ।

হঠাৎ বাসন সরানর শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঘুরে তাকালাম টেবিলগুলোর দিকে। এক মুহূর্তের জন্য গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হল, সব টেবিল থেকে একদল ছায়ামূর্তি যেন অদৃশ্য হয়ে গেল! সেই হলের দরজার ভেতর থেকে যেন এক্ষুনি কেউ এসে গামলা নিয়ে হাতা হাতে দাঁড়াবে। ভয়ে পিছু হটতে গিয়ে পিঠ ঠেকে গেল দেয়ালে। হল তেমনই খালি। আলগা হাওয়ায় কোথায় আবার যেন একটা কাঁচের বাসনের মত কিছু ঠুং ঠুং শব্দ করে উঠল। বেরিয়ে পড়লাম হল থেকে, আমার এক্ষুনি রুমে ফিরে যাওয়া দরকার।


“গুড ইভনিং!”

চমকে পিছন ফিরে চেয়ে দেখলাম, থমাস কখন যেন ডিনার হল থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেই সাদা হাফ শার্ট আর ধুতি। মুখে সামান্য হাসি। বাল্বের আলো আড়াল হতে ভদ্রলোককে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। আমি অপ্রতিভভাবে বললাম, “গুড ইভনিং। আমায় একটু আগে ডেভিড এসে ডাকল চায়ের সময় হয়েছে বলে। আমি আসলে হলে কাউকে না দেখে…”

“আরে নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আমি আসলে কিচেনের ভেতরে ছিলাম একটু রান্নার তদারক করার জন্য। আপনি বসুন, আমি একবার মারিয়াকে বলে আসি। দুধ চা তো? সাথে কয়েকটা কুকিজ নিয়ে আসি? আজই বানানো হয়েছে। ফ্রেশ।” বলে আমার সম্মতির অপেক্ষা না করেই ভদ্রলোক হলের পিছনের দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলেন। এবার লক্ষ্য করলাম, সেদিকটা একেবারে অন্ধকার। ছবিতে দেখা সেই উঁচু টেবিলটার ওপর রাখা আছে সেই টিনের গামলাটা। আমি যখন এলাম এটা কি তখনও এখানে ছিল? হলে ঢুকে দেখেছি কি না কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। মনভরা অস্বস্তি নিয়ে ধিরে একরকম নিমরাজি হয়ে একটা একটা টেবিলে গিয়ে বসলাম। টেবিলক্লথটা ময়লা হয়ে গিয়েছে, দেখে মনে হল কোন সময় সেটার রং হয়ত সাদা ছিল।

একটা কাপ আর একটা প্লেটে কুকিজ নিয়ে থমাস ফিরে এলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই, গামলা থেকে একটা খাটো টিনের মগ দিয়ে চা তুলে আমার সামনে এনে রাখলেন। সাথে ছোট্ট সাদা প্লেটের ওপর রাখা একটা সাদা কার্ড, তার একপিঠে একটা হোটেলের লোগো আঁকা, অন্য পিঠে লেখা “Poftă bună!”। এরকম অদ্ভুত কায়দায় চা পরিবেশন দেখে বেশ অবাক হলাম। টি পট নেই, চিনির পাত্র নেই, যেন গামলার ভেতর থেকে মন্ত্রবলে মগে চা উঠে এল। কার্ডটা পকেটে পুরে নিলাম। তারপর ফুঁ দিয়ে দ্বিধাভরে চায়ে চুমুক দিলাম। থমাস কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন আমি চায়ে চুমুক দেয়া পর্যন্ত। তারপর কতকটা জবাবদিহি দেয়ার গলায় বললেন, “রাতে আজ খাবার তৈরি হতে একটু দেরি হবে। আসলে ফাদার গোয়া থেকে রাতে আসবেন তো। তারপর ডিনার সারভ করা হবে। ডেভিড বেরিয়ে গিয়েছে তাঁকে আনতে।” ফাদার অর্থে কি সেই ভেতরের চার্চের ফাদার? জিজ্ঞেস করায় থমাস বললেন, “ফাদার রেবেলো গোয়াতেই থাকেন। প্রতি মাসের ১৩ তারিখে তিনি এখানে চলে আসেন। আজ ১৩ তারিখ। আজ আর কাল এখানে থেকে রবিবার চার্চের কাজ শেষ করে তিনি আবার ফিরে যাবেন।”

চায়ে চুমুক দিতে দিতে আবার বললাম, “আপনাদের ফোন কি ঠিক হয়েছে? আমায় কিন্তু ব্যাঙ্গালোরে খুব জরুরী একটা ফোন করতে হবে। মোবাইলে কিছুতেই টাওয়ার আসছে না গোকর্ণ এসে থেকে।” থমাসের মুখে কৌতূহলের অভিব্যাক্তি স্পষ্ট, ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম ডেভিডের মুখে মোবাইলের কথা শুনে। তিনি একটু চুপ করে বললেন, “টাওয়ারের ব্যাপারে ঠিক বলতে পারব না। আমি অপারেটরের সাথে কথা বলে দেখছি যদি আপনাকে কোনভাবে সাহায্য করা যায়।” আবার সেই এক কথা! লোকগুলোর এরকম অদ্ভুত কায়দার কথায় প্রথম প্রথম বেশ আমোদ হচ্ছিল শুনতে। কিন্তু এই আবছায়া সেকেলে ডিনারহলে থমাস যখন পোশাকি হাসি হেসে নিঃশব্দে রিসেপশনের দিকে চলে গেলেন, তখন মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠল। অদ্ভুত লোক তো! মানুষের সুবিধে অসুবিধে সম্পর্কে যেন কেন উদ্বেগ নেই। সে হোক না হোটেলের একমাত্র অতিথি! সন্দেহ নেই এখানে বেশ গোলমেলে কিছু একটা ঘটছে। চা টা শেষ করতে করতে একরকম ঠিক করে ফেললাম, যদি আজ ফোন করতে না পারি বা লাইন না পাই, কাল সকালে উঠে আর এখানে থাকব না। এ জায়গা আমার ভালো লাগছে না। মাথায় উঠেছে আমার ওম বিচ দেখা। কাল সকালে আগে বাস স্ট্যান্ডে ফিরে গিয়ে সেই ওয়েলকাম লজের খোঁজ করব। তারপর অন্য কাজ।

উঠে হল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে আনমনেই কি না জানি না, আর একবার সেই ফটোটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখলাম। এরই মধ্যে কি কিছু বদলে গেল নাকি ছবিতে? হাল্কা বাল্বের আলোয় দেখলাম, এবার ছবিতে যে হলটা দেখা যাচ্ছে, সেখানে দেয়ালে একটিও ছবি নেই। তার চেয়েও গোলমেলে একটা যিশুখ্রিষ্টের ক্রশ, সেটা টাঙানো আছে দেওয়ালে, কিন্তু উল্টো করে। অথচ এখন সেটা দেওয়ালে স্বাভাবিক সোজা করেই টাঙানো তা তো দেখাই যাচ্ছে। হলের একধারে যেদিকে সেই রাঁধুনি ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, সেদিকেও চোখ পড়ল। তিনি সেই মৃত দৃষ্টিতে ক্যামেরার দিকে চেয়ে আছেন। কিন্তু তাঁর পেছনে আর একটি মানুষের অবয়ব আবছা বোঝা যাচ্ছে দরজার অন্ধকারে। বেঁটে খাটো একটি মানুষ, দুহাত পেছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে সম্ভবত একটি সাদা হাফশার্ট আর পরনে দক্ষিণী কায়দায় পরা সাদা ধুতি।

হঠাৎ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। অস্বাভাবিকত্বটা আমি ধরতে পেরেছি। এই ছবি ঠিক সেখান থেকেই দাঁড়িয়ে তোলা, যেখানে আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি। অথচ এখান থেকে ঘুরে এই সামান্য সরু জায়গায় দাঁড়িয়ে এত লম্বা হলের ছবি তোলা কোনভাবেই সম্ভব নয়। ফটোগ্রাফ না হলে অনায়াসে বলা যেত, ছবিটা একটা আয়নার মধ্যে দিয়ে দেখা এই হলের প্রতিচ্ছবি। ছবিতে যে টেবিলে আমি বসেছিলাম একটু আগে, সেই টেবিলটা এখন খালি। কেবল একটা কাপ আর প্লেটে একটা বিস্কুট বা কুকিজ জাতীয় কিছু রাখা। অথচ একটু আগেই যখন ছবিটা দেখেছি, তখন ওই টেবিলে একটি কাফ্রি দম্পতির ছবি দেখতে পেয়েছি তা আমার পরিষ্কার মনে আছে। কাপ প্লেট কিছুই সেখানে ছিল না।

হলের আলোগুলো হঠাৎ দপদপিয়ে উঠল। আমার পিঠ বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত কোমরের দিকে নেমে গেল। কান ভোঁ ভোঁ করে উঠল। বুঝতে পারলাম, রীতিমত গলা শুকিয়ে এসেছে। কোনমতে আজ রাতটুকু কাটিয়ে যেভাবে হোক কাল সকালের মধ্যে এখান থেকে বেরতেই হবে। সেই অন্ধকার থামঘেরা বারান্দা দিয়ে ফিরে আসতে আসতে ভয়ে ভয়ে আর একবার পেছনে ফিরে দেখলাম, একটি স্থূলকায় মহিলা, রাঁধুনির পোশাকে আমার কাপ আর প্লেট তুলে নিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।



‘মতিভ্রম’ বলে একটা কথা আছে। কোন এক অজ্ঞাত কারণেই হোক আর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যাবহার, মানুষ কোন কোন সময় বুঝতে পারে সমূহ বিপদের উপস্থিতি। কিন্তু সেসময় এই মতিভ্রমের কারণে সে যে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে, তাতে বিপদের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়াটা মোটেই আশ্চর্য নয়। আমিও যখন কোনমতে করিডোর পেরিয়ে যখন ঘরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম, তখন ভয় আমার কিছুটা কমে এসেছে। দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়ে ফের ছিটকিনি তুলে দিয়ে বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। ঘরের আলো উজ্জ্বল। তাছাড়া চার দেওয়ালের মধ্যে সঞ্চিত নিরাপত্তা আমার মনের সাহস বেশ কিছুটা বাড়িয়ে তুলল। নিশ্চয়ই কিছু ভুল দেখেছিলাম আমি ওই আবছায়ামার্কা আলোতে। রাঁধুনি ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই ডেভিডের মা মারিয়া। এতক্ষণ না খেয়ে আর এতখানি বাসযাত্রার ক্লান্তিতে মাথাটা যে একেবারে কাজ করছে না, সে জন্য নিজেকেই মনে মনে গাল দিলাম। কি ভুলভাল দেখছিলাম, তাও কি না এত স্পষ্ট।

ঠিক করলাম, রাতেও খাবার সময় ওই হলেই যাব, আর এবার মারিয়াকে ডেকে তাঁর সাথে আলাপ করব। কুকিজগুলো সত্যি চমৎকার বানানো হয়েছিল, আরও কয়েকটা খেতে পারলে খিদেটা দিব্যি মিটত। পকেট থেকে সেই কার্ডখানা বের করে এবার ব্যাগে ভরে ফেললাম যত্ন করে। কাল যাওয়ার সময় থমাসের কাছে খোঁজ নিতে হবে এই হোটেলের নাম্বার আর ঠিকানা দেওয়া কোন কার্ড আছে কিনা। হ্যাঁ, যাওয়ার ব্যাপারটায় আমার সিদ্ধান্ত স্থির, কারণ এই জঙ্গলের মধ্যে পাণ্ডববর্জিত জায়গায় গুটিকয় মানুষের সান্নিধ্যে এরকম গা ছমছমে হোটেলে থাকা আমার একার কম্ম নয়। পরের বার যদি বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসি তখন বরং এই হোটেলে থেকেই হই হই করা যাবে। ব্যাগটা মোটামুটি গুছিয়ে ক্যামেরার খাপে কার্ডটা ভরে নিয়ে পোশাক বদলে ফেললাম। ভাবলাম ফোনটা সেরে রাতেই জানিয়ে আসব থমাসকে, যে কাল সকালে আমি চলে যাচ্ছি। যাওয়ার সময় ডেভিডকে কিছু বখশিশ আলাদা করে দিয়ে ওম বিচটা দেখে নেওয়া যায় কি না সে ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা করতে করতে ঘর খুলে আবার বাইরে এলাম।

কতক্ষণ সময় লেগেছিল আমার ব্যাগ গুছিয়ে বেরতে? আধ ঘণ্টার বেশী হওয়ার তো কথা নয়। এর মধ্যেই করিডোরের ইলেকট্রিক আলোগুলো নিভিয়ে মোমদানিতে মোম বসিয়ে জ্বালিয়ে গেল কারা! করিডোরের ওপ্রান্তে যেদিকে ডিনার হল, সেদিকটা এখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঢাকা। রিসেপশনের দিকে একটা আবছা আলো দেখা যাচ্ছে, একটা হলুদ আলোর টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে সেখানে। মনে হল থমাস রিসেপশনের মাথা উঁচু চেয়ারটায় বসে আছে বাইরের দিকে মুখ করে। আমার মনে আবার সেই ফেলে আসা ভয়টা ধিরে ধিরে দানা বাঁধতে শুরু করল, কান খাড়া হয়ে উঠল। এত শিগগির সব এমন বদলে গেল কি করে? পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম রিসেপশনের কাঠের টেবিলটার দিকে।

রিসেপশনের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতেই থমাস চেয়ার ঘুরিয়ে আমার দিকে ফিরলেন। একটা হাত মুখের ওপর চাপা দিয়ে বোধহয় কপালটা ডলছিলেন তিনি। আমি সামান্য হেসে জিজ্ঞেস করলাম “মাথা ব্যথা?”

“কই না তো!” বলে কি যেন এড়িয়ে গেলেন থমাস।

“হঠাৎ আলোগুলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালালেন যে?”

থমাস উত্তর দিলেন, “ফাদার রেবেলো মোমবাতির আলো বেশী পছন্দ করেন। ওই ছবিটাও ওনার আঁকা, ওনারই প্রতিকৃতি। দেখুন।”

তেলরঙে আঁকা সেই বিরাট ‘The Spirit of the Bagpiper’ ছবিটা তখন অন্ধকারে ঢেকে কেমন যেন কিম্ভূত দেখাচ্ছে। এই বুড়োই তাহলে ফাদার। আপনমনে থমাস বলে চলেছেন, “রোমের এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর কাছে তেলরঙ দিয়ে আঁকতে শিখেছিলেন রেবেলো অল্পবয়সে। তারপর এখানে এসে…”

বুড়োর ইতিহাসে আমি তেমন ঔৎসুক্য না দেখিয়ে একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম, “আচ্ছা আপনাদের চেক আউট টাইম কখন?”

“চেক আউট,” কথাটা যেন আপন মনেই উচ্চারণ করলেন ভদ্রলোক। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। এখন চোখে পড়ল কপালের যে জায়গাটায় ডলছিলেন থমাস, সেখানে চামড়া কুঁচকে রইল, ঠিক যেমন বিছানার চাদর কুঁচকে থাকে।

“চেক আউটের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন কেন স্যার? কিছু অসুবিধে হয়েছে?”

“না ঠিক তা নয়। আসলে আমার এক বন্ধু আমি এখানে আসার কথা শুনে গোকর্ণে আগেই আমার জন্য একটা লজ বুক করে রেখেছিলেন। সেই লজ থেকে যদি আমার আসার কথা তাঁকে না জানায়, তাহলে তিনি আবার চিন্তা করবেন। আমি বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলাম, আর দোকানপাট সমস্ত বন্ধ দেখে বুঝতেও পারছিলাম না কি করব, তাই ডেভিডের সাথে চলে আসি। কিন্তু কাল তো আমায় ফিরে যেতে হবে সেই লজে, নাহলে একটু মুশকিলে পড়ে যাব আমি। আপনি আমার যা বিল হবে খাবার দাবার মিলিয়ে, সেটা ডেভিডের হাতে দিয়ে দিলেই হবে। আমি কাল গোকর্ণ পৌঁছে ওর হাতে টাকা দিয়ে দেব।” উত্তরে আবার সেই পোশাকি নিঃস্পৃহ হাসি হেসে একটা অদ্ভুত কথা বললেন থমাস বিজয়ন।

“আমাদের তো কোন চেক আউট টাইম নেই স্যার!”

“চেক আউট টাইম নেই মানে?”

উত্তরে থমাস দেওয়ালে একটা বোর্ডের দিকে হাত দেখালেন। সেখানে ‘চেক ইন - ’ বক্সের পাশে লেখা আছে “Always”, আর ‘চেক আউট- ’ এর পাশের জায়গাটা ফাঁকা। এর মানে কি? তাহলে কি এখান থেকে যেকোনো সময়ই বেরিয়ে পড়া যায়? আমি কিছুই না বুঝতে পেরে বললাম, “বেশ, তাহলে কাল সকালে ডেভিড বাজার যাবে যখন, আমি তখনই নাহয় ওর সাথে বেরিয়ে যাব।” থমাস আমার দিকে নিস্পলক চেয়ে রইলেন, কপালের সেই জায়গাটা তেমনই কুঁচকে রইল। ব্যাপারটা খুবই অস্বস্তিকর। মোমের আলো ক্রমে আবছা হয়ে আসছে করিডোরে। সেই আবছা আলোয় ওনার মুখটা কেমন যেন জায়গাচ্যুত রবারের মুখোশের মত লাগছে। আমি অস্বস্তিটা জোর করে চেপে রেখে থমাসকে আবার জিজ্ঞ্যেস করলাম, “এখন ফোন করা যাবে কি?”

থমাস যন্ত্রচালিতের মত টেবিলের নিচ থেকে ফোনটা তুলে কাউন্টারের ওপর রাখলেন, মুখে কিছু বললেন না। আমি কানে রিসিভার লাগিয়েই টের পেলাম, বরফের ছ্যাঁকার মত ঠাণ্ডা সেটা। মোবাইল দেখে লক্ষ্মীবাবুর নাম্বারটা ডায়াল করতে লাগলাম করিডোরের দিকে চেয়ে। একটা একটা করে দরজা ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারের আড়ালে। যেন জ্বলতে জ্বলতে মোমগুলো একটু একটু করে নিভে যাচ্ছে, আর ক্রমে সমস্ত হোটেলটাকে গ্রাস করছে অন্ধকার। লক্ষ্মীবাবুর নম্বর ডায়াল করে ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরে রইলাম, চোখের সামনে আলোগুলো নিভতে লাগল। কিছুতেই লাইন পাচ্ছি না, এমনকি ডায়ালটোনও না। থমাসের মুখে সেই নিঃস্পৃহ হাসিটা ক্রমে যেন বিদ্রূপের আকার নিল।

“কি হল লাইন পাচ্ছেন না?”

হঠাৎ একটা মৃদু আওয়াজ কানে এল ফোনের ভেতর থেকে, অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে সেটা। কোন বাঁশির বা ওই জাতীয় কোন বাজনার শব্দ। কোথায় শুনেছি এই আওয়াজ, সুরটা চেনা চেনা। কান পেতে ভালো করে শুনলাম। সেই সুরের সাথে পাশাপাশি মিশছে আরও একটা শব্দ। সেটা যদিও বাইরে থেকে আসছে, জঙ্গলের ভেতর থেকে। বাহ্যহারা হয়ে তাকালাম জঙ্গলের দিকে, বাইরে। আর একটু পরে বুঝতে পারলাম, ওটা মোটরবাইকের ভট ভট শব্দ। কিন্তু কোথায় বাইক? শব্দ এলেও সেই মস্ত লোহার আলোটা দেখা যাচ্ছে না কেন? যেন কেউ জুতোর কালি দিয়ে ঘষে ঘষে সমস্ত জঙ্গলটা একটা কালো তেলতেলে রঙে ডুবিয়ে দিয়েছে। সেই অন্ধকার উঠে আসছে গেট পার হয়ে লনের ওপর দিয়ে। ফোনের ভিতরের আওয়াজ তখন স্পষ্ট, আর চেনা। আমার স্বপ্নে শোনা সেই ব্যাগপাইপের সুর। ভয়ে আমার হাত পা অসাড় হয়ে গেল। বাইরে তখন বাইকের শব্দ এসে স্থির হয়েছে বাগানের কাছে। ক্যাঁচ করে সেই মস্ত লোহার গেট খোলার আওয়াজ পেলাম। কি আশ্চর্য, কোন আলো নেই কেন আজ চারিদিকে!

দপ করে হঠাৎ গেটের কাছে মস্ত গাছটায় আগুন জ্বলে উঠল মশালের মত। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল গাছটা। আর সেই আলোয় আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, গোটা জঙ্গলটা জেগে উঠেছে এই অশুভ সুরের মূর্ছনায়। জঙ্গল থেকে দলে দলে কাদের যেন ছায়ামূর্তি ভিড় করে এগিয়ে আসছে সেই ব্যাগপাইপের শব্দে। কত-শত শতাব্দীর পর সেই সুর তাদের টেনে এনেছে এক জীবন্ত মানুষের অনির্বচনীয় অভিশপ্ত পরিণতিকে পরিসমাপ্তি দেবার উদ্দেশ্যে। গেটের কাছ থেকে একটা দীর্ঘ লম্বা দেহ কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে না?

করিডোরের ওদিকে তখনও তিন-চারটে মোম জ্বলছিল, দেখলাম অন্ধকার করিডোরেও এসে দলে দলে ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়েছে। তাদের প্রত্যেকের পোশাক আলাদা করে চেনা যায়। সেকেলে ফ্যাশানের সেই ছবির মত। কারো মাথায় টুপি, কারো পরনে ফ্রক। রাঁধুনির পোশাক পরা সেই স্থূলকায় মহিলা। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে চাপা সেই গন্ধটা আর ব্যাগপাইপের সুর। আমি ফোন ছেড়ে ভয়ে পিছিয়ে যেতে গিয়ে কিসে যেন হোঁচট খেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলাম। আর বিস্ময়ে ভয়ে আতঙ্কে চেয়ে রইলাম সেই রিসেপশনের কাউন্টারের দিকে। থমাস তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু তাঁর মুখ দেখে চেনার উপায় নেই তাঁর চেহারা। ঘন ঘন মাথা নড়ছে তাঁর, আর সাথে সাথে কপালের চামড়া, নাক, চোখ, ঠোঁট, সমস্ত ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে সেই মুখে। চামড়া লম্বা হয়ে ঝুলে বেয়ে পড়ছে চোয়াল বেয়ে। থমাসের দেহটা ক্রমে যেন সাপের ফণা তোলার মত লম্বা হয়ে উঠতে লাগল। ছায়ামূর্তিগুলো একসাথে জমায়েত হতে লাগল উল্লাসে। দেখতে দেখতে নাক চোখ অদৃশ্য হয়ে গেল সেই কুঁচকে যাওয়া চামড়ার আড়ালে। তখন তাকে মানুষ বলা চলে না আর। প্রকাণ্ড একটা দলা পাকানো মাংসপিণ্ডের মূর্তি যেন প্রায় মানুষের মত অবয়ব ধরে উঠে আসছে কাঠের টেবিলের আড়াল থেকে। আর একটাই মোমবাতি অবশিষ্ট আছে। মোমবাতির আবছা আলো খাবি খেয়ে নিভে যাওয়ার আগে দেখতে পেলাম, সেই ছায়ামূর্তির মিছিল এসে দাঁড়িয়েছে থমাসের পেছনে। থমাসের দেহ দুহাত বেয়ে মাকড়সার মত এগিয়ে এসছে মেঝের ওপর দিয়ে।

মাথার পেছনে এখন সেই তেলরঙে আঁকা ছবিটার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে অবিকল সেই স্বপ্নে দেখা ব্যাগপাইপারধারী বৃদ্ধ। বুক চিরে অসংখ্য হাত এসে কিলবিল করছে ব্যাগপাইপের ওপর। নল থেকে একবারও ঠোঁট না তুলে স্মিত মুখে সে অবিরাম বাজিয়ে চলেছে মাথা ঝিমঝিম করা সেই সুর। সমস্ত ঘরটা ভরে উঠেছে সেই জ্বলন্ত গাছের হলদেটে আভায়।


এর পরের ঘটনা আমার লোকের মুখে শোনা।

হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আমি সেই বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে বসে আছি। বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, আকাশ অন্ধকার। দন্তবিকশিত সেই চাওয়ালা আমায় ডেকে বলছে তাদের স্থানীয় ভাষায় কিছু। আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়লাম আমি। কোথায় আছি, সময় কত, সমস্ত ব্যাপারটা আত্মস্থ করতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। ইতিমধ্যে ফেরার বাস এসে দাঁড়িয়েছে, বাসের সেই খালাসিটি অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। তখন সোমবার দুপুর দুটো। মাথার যন্ত্রণা আর গায়ের অসহ্য ব্যথা থেকে টের পেলাম, আমার বেশ জ্বর। কোনমতে ওঠানো হয়েছিল বাসে সামান্য ওষুধ পত্রের পর। ব্যাগ আমার কোলেই পড়ে ছিল, সমস্ত জিনিস তাতে যথাস্থানে পাওয়া গেল। এমনকি আমার সাধের ক্যামেরা আর পার্সও। খালাসি রাস্তায় যেতে যেতে জানাল, লক্ষ্মীবাবু নাকি বেশ চিন্তায় ছিলেন আমি এখানে এসে থেকে আর কোন ফোন করি নি বলে। শুক্রবার রাতে তিনি নিজেই ওয়েলকাম লজে ফোন করায় তারা বলে, আমি তাদের ওখানে উঠিনি।

পরে চায়ের দোকানওয়ালা কি বলেছে তাও আমি শুনলাম। আমি নাকি এই দুদিন কোথায় ছিলাম সে জানে না। স্থানীয় কেউই আমায় দেখে নি। শেষ দেখা গিয়েছিল আমায় হাঁটতে হাঁটতে ওম বিচের দিকের রাস্তায় এগিয়ে যেতে। সেই সোমবার সকালে এসে দোকান খোলার পর বেলা দশটার দিকে আমি জঙ্গলের দিক থেকে ব্যাগ পিঠে হেঁটে আসি, এবং এসে তার দোকানের বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে থাকি। এরপর ঘুমিয়ে পড়ি। খালাসি দোকানে আমায় নামিয়ে বলে গিয়েছিল যে ওইদিন দুপুরে তাদেরই বাসে আমার ফেরার কথা, তাই চাওয়ালা আর আমায় ডাকে নি। আশপাশের লোকজন একজন স্থানীয় ডাক্তারকে খবর দিলে তিনি নাকি এসে আমায় ভালোভাবে পরীক্ষা করে শেষে হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। যদিও আমি তখন জ্ঞানহারা হয়ে থাকায় সেসব কিছুই আমি টের পাইনি। একেবারে বাস আসায় তারাই আমায় কোনমতে তুলেছে। এই গোটা দুটো দিন আমার ক্যালেন্ডার থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।

গায়ে জ্বর নিয়ে প্রলাপ বকতে বকতে সেবার ব্যাঙ্গালোর ফিরে বেশ কিছুদিন আমায় হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিলেন আমার ইনফ্লুয়েঞ্জা বা জঙ্গলের কোন পোকা মাকড়ের কামড়ে কোন বিদঘুটে ইনফেকশন হয়েছে। পিঠে ও বুকে তিনি অজস্র মশার কামড়ের মত চাকা চাকা দাগের কথা আমায় নিজে বলেছিলেন। সুস্থ হয়ে উঠে একদিন দেখা করে লক্ষ্মীবাবুকে সব কথা খুলে বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তিনি কিছুই বিশ্বাস করেন নি। ‘The Bagpiper’s Nature Stay’, থমাস বিজয়ন, ডেভিড এমনকি ফাদার রেবেলোর কথাও কেউ জানেন না। আমি এই হোটেলটি সম্পর্কে বা চার্চটির ব্যাপারে আর কোন তথ্য বহু চেষ্টা করেও আজ অবধি জানতে পারিনি। শনি আর রবিবার আমি কোথায় ছিলাম, কি করেছিলাম, আর কোথা থেকেই বা সেই চায়ের দোকানে সোমবার ফিরে এলাম, সে স্মৃতিও আমার কাছে নেই। সাহসে কুলায় নি যে আবার গিয়ে খোঁজ করে দেখি সেই হোটেল বা চার্চ সত্যি সেখানে আছে বা ছিল কি না।


২০১২ সালের শেষের দিকে একেবারে সিজনের সময় মস্ত একটা বন্ধুর দলের সাথে আমি আবার গোকর্ণ যাই। গোকর্ণের আমূল পরিবর্তন হয়েছে এখন। বেড়েছে লোক চলাচল, সুযোগ-সুবিধে। ‘The Spirit of Bagpiper’ নামের একাধিক ছবি আঁকা হয়েছে নানা কালে বলে শুনেছি। তার মধ্যে অনেকগুলোর চিত্রকরের নাম, বা কবে কি উপলক্ষ্যে আঁকা হয়েছিল তা জানা যায় না।

আমার কাছে সেই ডিনারহলের কার্ডখানা আমার কাছে এখনও আছে। এখনও কোন কোন সন্ধেতে আকাশে মেঘ করে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলে বাতাসে কোন অপার্থিব উপায়ে যেন আমার কানে ভেসে আসে ব্যাগপাইপের সুর, চোখে ফুটে ওঠে সেই অসহনীয় বীভৎসতার স্মৃতি। তখন সেই কার্ডটা বের করে মাঝে মাঝে দেখি আমি। আমার ডায়েরীর মধ্যেই যত্ন করে রাখা সেটা। আর একটা ছোট্ট বদল সেখান থেকে ফেরার পর আমি লক্ষ্য করেছিলাম, যেটা আমার আগে ছিলনা। আমার ঘাড়ের কাছে একটা উল্কি নিয়ে ফিরেছিলাম। কোন ছবি বা চিহ্ন নয়, তাতে একটা তারিখ লেখা। রোমান সংখ্যা থেকে অনুবাদ করলে ইংরেজিতে সেটা হয় ‘19.12.1969’। গোয়ার স্বাধীনতা দিবস, কিন্তু সালটা কেন ভুল তা এই ঘটনার ব্যাখার মতই অজানা।

এরকমই একটা উল্কি আমি ডেভিডের গায়ে দেখেছিলাম।


ও আর একটা কথা, অবশ্য সেটা না বললেও চলে যায়। ফটোগুলো পরে ওয়াশ করা হয়েছিল, যেগুলো আমি সেই জঙ্গলে ঢোকার সময় তুলেছিলাম। ভারি সুন্দর এসেছিল সেগুলো।

লাখটাকার ছবি।


একটা ছবিতে ডেভিডকে বাইকে বসা অবস্থায় তুলেছিলাম। সেটা যদিও ওঠে নি।


© All rights reserved by Copyright Act 2020, Department of Art and Culture, Government of India

Copyright Office, New Delhi 110025




Comentários


Subscribe Form

  • facebook
  • twitter
  • linkedin

©2020 by | Seek to See Beyond |. Proudly created with Wix.com

bottom of page