top of page

নেইবাড়িঃ পর্ব ১

Writer: অতিমানবঅতিমানব

Updated: Jun 20, 2020

মুখবন্ধ


স্বীকার করছি, গল্পের শুরুতেই “সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে…” কিংবা “সেই রাত যে কিভাবে কেটেছিল…” জাতীয় কথা লিখে মনকে একটা ভয়ানক বিভীষিকার জন্য প্রস্তুত করে নেয়াকে আমি মোটেই প্রশ্রয় দেই না; কাজেই ভূতের বা অলৌকিক গল্পের ভক্ত আমি নই। ছেলেবেলা থেকেই এরকম গল্পসম্ভার আমি একরকম এড়িয়েই চলতাম। এমনকি পরে বয়েসকালে ভূতের সিনেমাও তেমন দেখি নি। আমার পেশাটা এমন, যে সেখানে কল্পনার মায়াজালের অবকাশ জীবনে প্রায় থাকেনা বললেই চলে। তাই ভূত-প্রেত-দৈত্য-দানব-পক্ষীরাজ ঘোড়া সবার স্থান একই পঙক্তিতে, সকলের নিচে। আমার মতে প্রকৃত ভয় কখনও আভাষ দিয়ে বা কড়া নেড়ে এসে উপস্থিত হয় না। অথচ যখন আসে, তখন অসহায়ের মত তাতে আকণ্ঠ ডুব দেওয়া ছাড়া আর কিছু করবার থাকে না। অভিজ্ঞতার শেষে পড়ে থাকে কিছু অনুভূতিরা, যা যুক্তিবুদ্ধির প্রতি এক অকারণ সন্দেহ তৈরি করে রেখে যায়। যে ঘটনার কথা বলতে এই গল্পের অবতারণা, তা আমার জীবনে এরকমই একটা সন্দেহের ছাপ ছেড়ে গেছে। কয়েকটা দিন নিছক ছুটি কাটাতে গিয়ে যে কয়েকটি চরিত্রের সাথে আমার আলাপ হয়ে গিয়েছিল, এবং কোনমতে সেখান থেকে যে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিলাম, সেজন্য ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ। এই ঘটনার কথা আমার কাছের বন্ধুরা সকলেই জানেন, আর কারো কারো মতে পুরো ব্যাপারটাই আমার মনগড়া। মাঝে মাঝে এখনও ভাবি সত্যিই সেসব ঘটেছিল কি না। আমার বেড়াতে যাবার সেই পুরনো ব্যাগটা তখন মাঝে মাঝে খুলে দেখি। যাক গে; পুরোটা খুলে না বললে পাঠককুল ভাববেন, আমিও বুঝি তাঁদের প্রস্তুত করে নিতে চাইছি এক নিতান্ত আজগুবি গল্প বলার খাতিরে। তাই আর গৌড়চন্দ্রিকা না করে একেবারে বলে ফেলাটাই সমীচীন।



সাল ২০০৫। ব্যাঙ্গালোর শহর তখন অদ্বিতীয় প্রযুক্তির পীঠস্থান বলে পরিচিত হওয়ার পথে জোরকদমে এগিয়ে চলেছে। বাগানঘেরা এই বৃহৎ শহরে আমার তখন থাকা হয়ে গিয়েছে প্রায় বছর তিনেক। একটি বহুজাতিক সংস্থায় কাজ করার সুবাদে আমার জীবনশৈলী তখন এতটাই যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, যে মাঝে মাঝেই শহর থেকে পালাতে ইচ্ছে করত। অনেক ভেবেচিন্তে ব্যাঙ্গালোর শহরকে কাজের জন্য বেছে নিতে হয়েছিল। পাড়াগাঁয়ে মানুষ আমি, গাছপালা না দেখলে মন হাঁপিয়ে ওঠে। শহরের দূষণ, হট্টগোল এবং গাড়িঘোড়ার ভিড়ের মধ্যে প্রায়শই নিজেকে অকারণে ক্লান্ত মনে হত। তাই দক্ষিণের কোন না কোন সমুদ্রতট বা হিলস্টেশনে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসা ছিল আমার নেশা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে এভাবে হারিয়ে যাওয়ার এই শখের সাথে আমার সহকর্মীরা সকলেই পরিচিত ছিলেন, তাই আমি ছুটি থেকে ফিরলেই ঘিরে ধরতেন কোন নতুন জায়গায় গিয়ে কিভাবে থাকলাম আর কি কি করলাম তার অভিজ্ঞতা শোনবার জন্য। মোবাইল ফোন আর ডিজিটাল ক্যামেরা তখনও মানুষের জীবনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে নি। তাই সে সময়টাও মানুষ মুখে বলা ভ্রমণকাহিনীর প্রতি অনুরক্ত ছিল বেশ। দক্ষিণীয় আমার যারা বন্ধুবান্ধব ছিল, তারাও মাঝে মাঝে নিজেদের সাধ্যমত বাতলে দিত নতুন জায়গার হদিশ। আমিও খোঁজ খবর করে পকেট সামলে বেরিয়ে পড়তাম সেই জায়গাগুলোর উদ্দেশ্যে। এমনিভাবেই কারোর কাছে শুনেছিলাম ওম বিচের কথা।

গোকর্ণ নামেটার সাথে অনেকেই পরিচিত। এই গোকর্ণ থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওম বিচ। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখনও ওম বিচে তেমন থাকার জায়গা তৈরি হয়ে ওঠে নি। আজকাল যদিও সাহেবসুবোরা গোকর্ণ থেকে শখ করে হেঁটেই যাতায়াত করে থাকেন ‘হাইকিং’ এর আনন্দে বলে শুনেছি। গোয়া ধাঁচের কিছু শ্যাক ও রিসোর্টও তৈরি হয়েছে। কিন্তু বছর দশেক আগেও ওম বিচের নাম কজন জানত, তা কড়ে গুণে দেখা যেত। দক্ষিণী বন্ধুটি বললেন, “পুরাণে আছে, ত্রেতাযুগে মহাবলি রাবণ এই ওম বিচ প্রতিষ্ঠা করেন আরাধ্য মহাদেবের লিঙ্গস্থাপন করে। গোটা সমুদ্রতটটা একটা “ওঁ” অক্ষরের মত দেখতে। লোকজন তেমন যায়না, গিয়ে দেখে এস এইবেলা।” সেটা মে মাসের প্রায় শেষ, ব্যঙ্গালোরে বর্ষাকাল প্রায় শুরু হল বলে। সমুদ্রে স্নান করার দুঃসাহস এইসময় কর্ণাটকের হিংস্র সমুদ্রতটে দেখাবার ইচ্ছে আমার ছিল না, সে কথা বলাই বাহুল্য। স্রেফ নিরালায় কদিন কাটাবো বলে, আর একরকম নীলগিরি আর উটির প্রতি বিরক্তই হয়ে বেরিয়ে পড়লাম গোকর্ণের পথে। ওদিকে আমার তেমন যাওয়া হয়নি।

‘নিসর্গ ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেল’-এর মালিক শ্রীযুক্ত লক্ষ্মীবাবু আমার পরিচিত। চশমাজোড়া কপালে তুলে তিনি বললেন, “গোকর্ণে এখন গিয়ে কি করবেন মশাই? এটা তো সময় না। বর্ষা প্রায় শুরু হল বলে, আর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিচ বন্ধ হয়ে যাবে। হোটেল যেকটা আছে তাও বন্ধ হয়ে যাবে টুরিস্ট আর স্টাফের অভাবে। এখন কেবল কিছু কেয়ারটেকার থেকে যায়। টুকটাক মেরামতি চলে যদ্দিন না আবার সব খুলছে। তাও ভালোভাবে খুলতে খুলতে সেই অক্টোবরের মাঝামাঝি। বলেন তো গোয়ার টিকিট করে দেই?” গোয়া এর আগে আমি দু’তিনবার গিয়েছি। কমবয়সে ব্যাচেলর ট্রিপে গিয়ে লোকে গোয়াতে যা করে, তাতে সেখানে গিয়ে শান্তিতে থাকাটা হবে না। তাছাড়া শহরের ভিড় কাটিয়ে এতদূর গিয়ে আবার শহুরে মানুষের ভিড়েই গা ভাসাতে ইচ্ছে হল না। তাই একরকম জোর দিয়েই ভদ্রলোককে রাজি করালাম গোকর্ণের জন্য। নিরাশ হয়ে তিনি বললেন, “বেশ। আসছে বৃহস্পতিবার রাতে গোয়ার একটা বাস ছাড়বে। তারা সকালের দিকে গোকর্ণে একটা হল্ট দেবে ওই চা-জলখাবারের জন্য। আপনি নাহয় তাদের সাথেই যাবেন। সেই বাসটাই আবার ফিরবে সোমবার দুপুরে, মঙ্গলবার ভোররাতে এখানে এসে ঢুকবে। সেইটে করেই আপনাকে ফিরতে হবে।” সবকিছু ঠিকঠাক করে নিসর্গের অফিস থেকে বেরোবার সময় লক্ষ্মীবাবু আবার ডেকে বললেন, “দেখুন মশাই, আপনি আমার বাঁধা খদ্দের তাই বলছি। গোকর্ণে আমার চেনা একটাই হোটেল আছে, ‘ওয়েলকাম লজ’। তেমন ভালো না, কিন্তু আর কোন হোটেল এখন খোলা পাবেন কিনা বলতে পারছি না। সেখানে আমি ফোন করে আপনার একটা বুকিং করিয়ে দেব, থেকে যাবেন। আর পৌঁছে হোটেল থেকেই একটা ফোন করে দেবেন আমার অফিসে। বৃষ্টির জন্য অনেকসময় মোবাইলে টাওয়ার থাকে না।” লক্ষ্মীবাবু এর আগেও অনেকবার আমার হোটেল করিয়ে দিয়েছেন এভাবেই, তাই সন্দেহের কোন অবকাশ রইল না। হাতজোর করে তাঁকে আর একটি ধন্যবাদ দিয়ে এগিয়ে পড়লাম বাজারের দিকে। একটা কোডাকের পুরনো স্টিল ক্যামেরা আমি ব্যাবহার করতাম তখন, ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ফিল্মের ছবি তুলবার শখ ছিল আমার।



বাস থেকে যখন নামলাম গোকর্ণের বাসস্ট্যান্ডে, তখন সকাল আটটা। আকাশ দেখে যদিও বোঝার মোটেই উপায় নেই যে তখন সকাল। দূরে সমুদ্রের ওপর একটা জায়গায় আকাশের কিছুটা ছাইচাপা আলোর মত হয়ে আছে দেখে বোঝা যায়, সেখানে সূর্য লজ্জায় মুখ ঢেকে আছেন। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মাঝে নোনা হাওয়ার আর পাতার গন্ধে ফুসফুস তাজা হয়ে উঠল। চায়ের দোকানে বসতে বসতে বাসের খালাসিটি বলল, তারা সোমবার দুপুরে যদি বৃষ্টির তেমন জোর না থাকে, তাহলে দুটোর মধ্যে এখানেই ফিরে আসবে আমায় তুলে নিতে। যদিও গোয়া থেকে ব্যাঙ্গালোরে ফেরার অন্য শর্টকাট রাস্তা তার জানা আছে, কিন্তু তার মালিক আলাদা করে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন এখান থেকেই আমায় নিয়ে ফেরার জন্য; অকারণে এই বাজারে তেল খরচা, ইত্যাদি। বোঝাই গেল, এই বাড়তি খাটুনিতে সে বা বাসের ড্রাইভার কেউই তেমন উৎফুল্ল নয়। সে যাক গে। গায়ের চামড়া মোটা ও কানের পর্দা বন্ধ করে সারারাতের ঝাঁকুনির পর চায়ে মনোযোগ দেয়াই সঙ্গত মনে হল আমার। যাওয়ার আগে বেচারাকে পঞ্চাশটা টাকা বকশিশ দিলাম, বলা যায়না হয়ত ফেরার সময় এলই না শেষকালে। চায়ের দোকানওয়ালাটি স্থানীয় কন্নড়ভাষী। তার হিন্দি ও ইংরিজিজ্ঞান এতই কম যে বেচারার আমি এই সাতসকালে একবাস লোক এনে তার দোকানের এইযে বিক্রিবাট্টার ব্যাবস্থা করে দিলাম সেটুকু বোঝাতে মিনিট পাঁচেক লেগে গেল। কেবল দন্তবিকশিত মুদ্রা দেখে আন্দাজ করতে পারলাম, এই বর্ষার দিনে ঘুমঘুমে সকালে সে হঠাৎ প্রায় শ’দেড়েক টাকার জলখাবার বিক্রি করে অবেলাতেই খুশিমনে শুঁড়িবাড়ি অভিমুখে প্রস্থান করবে।

গোলমাল বাঁধল ওয়েলকাম লজ খুঁজতে গিয়ে। আশপাশের কোন দোকান তখনও খোলে নি। আর আনতাবড়ি ঘুরে লটবহর নিয়ে হোটেল খুঁজে পাওয়ার মত শারীরিক শক্তি আমার প্রায় তখন নেই বললেই চলে। জামাকাপড়ের ব্যাগটা চায়ের দোকানে রেখে একটু এগিয়ে দেখব কি না ভাবছি, এমন সময় সেই দাঁতাল চাওলার বউ এসে হঠাৎ কি কারণে স্বামীটির ওপর সাংঘাতিক চেঁচামেচি শুরু করে দিল। বোধহয় সাত সকালে ঘরের বাচ্চাগুলির তদারক না করে চায়ের দোকানে এসে সে বাসের লোকেদের সাথে গল্প জুড়ে দেওয়ায় বউটির ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছে। ইতিমধ্যে বৃষ্টির জোর আরও বেড়ে ওঠায় দোকানী বেচারা ঝাঁপ আধা বন্ধ করে বউয়ের পিছুপিছু বোধহয় ঘরের দিকেই প্রস্থান করল। আমি কি করব কিছুই ঠাহর করতে না পেরে ব্যাগসমেত বসে রইলাম ঝাঁপের নিচে বাঁশের বেঞ্চিতে। বৃষ্টির ছাঁটে আমার ব্যাগের তেমন অসুবিধে হবে না, কিন্তু কোনভাবে ক্যামেরার লেন্সে ভেপার জমে ফিলমগুলো না নষ্ট হয়ে যায়, এই চিন্তায় যখন মনটা অন্যদিকে চলে গেছে, এবং ওয়েলকাম লজের দিকনির্দেশ না জেনে আসার কারণে এই বিটকেল বিপদে পড়ার কারণে মনে মনে নিজেরই মুণ্ডপাত করছি, তখন হঠাৎ পর্তুগীজ উচ্চারণে “গুড মর্নিং পাত্রোঁ!” শুনে প্রায় চমকে উঠলাম।

একটা ছেলে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা বেতের মত চেহারা, গায়ে একটা সাধারণ গেঞ্জি, বুকের কাছে একটা ক্রস লকেটের মত ঝুলছে। মাথায় একটা পুরনো জিন্সের ক্যাপ উল্টো করে পরা, বাঁ হাতের কব্জি থেকে কাঁধ পর্যন্ত অনেকগুলো উল্কি, যাকে চলতি কথায় ট্যাটু বলে। বয়স যতদূর মনে হয় বিশ-বাইশের বেশী না। এই তো ওদিকেই তাকিয়ে ছিলাম কয়েক সেকেন্ড আগে, মাত্র মাথাটা ঘুরিয়েছি ক্যামেরাটা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য। এর মধ্যে এ উদয় হল কি করে? ছেলেটা আমার দিকে আসতে আসতে আবার একগাল হেসে “গুড মর্নিং” বলল। না এবার উত্তর না দিলে অসভ্যতা করা হয়, আমিও হেসে অভিবাদন করলাম তাকে। মুখে কিছু বললাম না।

ছেলেটা চায়ের দোকানের ছাউনির তলায় এসে পর্তুগীজ টানে ইংরিজিতে জিগ্যেস করল, আমি এখানে ঘুরতে এসেছি কি না এবং হোটেল খুঁজছি কি না। ঘুরতে যান যারা, তারা সকলেই জানেন বাস স্ট্যান্ডে এবং রেল স্টেশনে এরকম বিভিন্ন বয়সী ছেলেরা নানা হোটেল থেকে এসে লোক টানতে চেষ্টা করে; যতদূর মনে হল এও তেমন কেউই হবে। আমি তাই তাকে সামান্য গম্ভীর হয়ে বললাম, “আমার হোটেল বুকিং করা আছে, বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছি। বৃষ্টিটা কমলেই এগব।”

ছেলেটা মুখে একটা নাছোড়বান্দা ভাব এনে বলল, “কোন হোটেল পাত্রোঁ?” ‘পাত্রোঁ’, অর্থাৎ পর্তুগীজ ভাষায় সাহেব বা মহাশয়।

আমি বললাম, “ওয়েলকাম লজ।”

“ওয়েলকাম লজ?”, ছেলেটা হেসে উঠল, “ওয়েলকাম লজ তো বন্ধ হয়ে গেছে পাত্রোঁ।” বন্ধ হয়ে গেছে মানে? আমি প্রায় আকাশ থেকে পড়ি।

“আমি মাত্র এই আগের সপ্তাহে তাদের কাছে টেলিফোনে বুকিং করে এসেছি। বন্ধ হতেই পারে না!” নাঃ! এ মনে হয় নিজের মালিকের হোটেলে আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বদ্ধপরিকর। ছেলেটা বলল, “না না পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয় নি। আসলে এই গত শনিবার এখানে প্রচন্ড ঝড় হওয়ায় ইলেকট্রিকের লাইন ডাউন হয়ে পড়ে আছে, তাই আপাতত কোন হোটেলেই গেস্ট নেই। দেখছেন না এখনও কোন দোকান খোলে নি। গোয়া থেকে ইঞ্জিনিয়ার আসবে লাইন ঠিক করতে আগামীকাল, তার আগে এখানে তেমন কিছুই খুলবে না।” আমি তখন অথৈ জলে। বলে কি! এই একবিংশ শতকে কোন জায়গায় এমন অবস্থা হতে পারে? মনে পড়ল, বছর কয়েক আগে এক ট্যুর কোম্পানির সাথে গিয়েছিলাম হিমাচলের এক ছোট্ট পাহাড়ি টাউনে। ডালহৌসির দিকে। সেখানেও এরকমই অবস্থা চোখে পড়েছে বটে। যতদূর মনে হয়, অফ সিজন বলেই হয়ত সরকারী ইঞ্জিনিয়াররা আসতে দেরি করছেন, বা আবহাওয়া খারাপের জন্যও হতে পারে। এখন উপায়? ছেলেটিকেই আবার জিগ্যেস করলাম, “আচ্ছা এখন ব্যাঙ্গালোরের দিকে কি কোন বাস যাবে? এখন বা বেলার দিকে?”

ছেলেটি একগাল হেসে বলল, “সেকি? চলে যাবেন কেন? আমাদের হোটেলে চলুন না। আমাদের ওখানে জেনারেটর আছে।” অবাস্তব মনে হলেও যে সময়ের কথা বলছি, তখনও ঘরে ঘরে ইনভারটার ঢুকে পড়েনি। মাহিন্দ্রা বা হন্ডার ডিজেল জেনারেটর সম্পন্ন মানুষদের বাড়িতে থাকত। আর হোটেলে সেই মান্ধাতা আমলের বড় বড় ডিজেল জেনারেটর। বিশেষত আশপাশের অবস্থা আর ছেলেটির সাজ-পোশাক দেখে মনে হল না তাদের হোটেল তেমন আহামরি কিছু হতে পারে বলে। আসার আগে লক্ষ্মীবাবুর সাথেও তো কথা হল না। কথা যা হয়েছিল, সেইমত তাঁকে পৌঁছনর খবর জানাবার জন্য পকেট থেকে মোবাইল বের করতে করতে বললাম, “তোমাদের হোটেলের নাম কি?”

“ব্যাগপাইপার নেচার স্টে।”

বাঃ! বেড়ে নাম তো! এমন অদ্ভুত হোটেলের নাম আমি কস্মিনকালেও শুনি নি। মোবাইলটা বের করে দেখলাম, টাওয়ার নেই।

“ওটা কি পাত্রোঁ?” ছেলেটা কৌতূহলী চোখে তাকায় আমার হাতের দিকে। আমি কিছুটা অবাক এবং বিরক্ত হয়ে বলি, “মোবাইল ফোন। কখনও দেখনি নাকি?” ছেলেটা আবার বলে, “মোবাইল ফোন কিরকম?” এবার সত্যি আমার অবাক হওয়ার পালা। আমি বললাম, “আরে মোবাইল ফোন জানো না? পকেটে নিয়ে লোকে ঘোরে, যেকোনো জায়গা থেকে ফোন করা যায়, দেখনি তুমি আগে?” মাথা নাড়ে ছেলেটা, “না পাত্রোঁ, এরকম জিনিস আমি আগে দেখি নি। ফোন তো আমাদের রিসেপশনে আছে, টেবিলের ওপর বসানো। এটা কি সেইরকম?” ছেলেটার সরল দৃষ্টিকে হঠাৎ খুব নিস্পাপ মনে হল আমার। সত্যি তো, কিই বা আছে এদের জীবনে এই ট্যুরিস্টদের দেওয়া সামান্য পয়সাকড়িকটা ছাড়া। অফ সিজনে হয়ত রোজগারও তেমন হয়না। হয়ত সত্যি মোবাইল দেখেনি এ। জায়গাটা এমন মড়া হয়ে যায় সিজনের বাইরে বলেই বোধহয় লক্ষ্মীবাবু আসতে বারণ করছিলেন। কিন্তু আর শরীরে দিচ্ছে না। এতদূর এসে ছুটিটা মাঠে মারা যাবে ভেবে মাথা গরম হয়ে উঠল। ছেলেটা ওদিকে অনুনয় করেই চলেছে, “আসুন না পাত্রোঁ, খুব ভালো হোটেল। বিচের একদম কাছে, ভিড়ভাড় থেকেও দূরে। আর আমাদের হোটেল থেকে একটা আলাদা বিচ একদম কাছে, আইল্যান্ডও আছে কয়েকটা। আমি নিজে আপনাকে বোটে করে সাইট সিয়িং করাতে নিয়ে যাব, একদম কম রেটে। তারপর ফোন আছে, ইন-হাউজ রেস্টুরেন্ট আছে, ফ্রেশ সি-ফুড! কত ভালো ভালো স্পট আছে ছবি তোলার জন্য।”

বৃষ্টিটা ধরে আসছে দেখে ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিলাম। জিগ্যেস করলাম, “কোন বিচ কাছে বললে?”

“একদম আলাদা একটা ফাঁকা বিচ। এখন কেউ আসবেও না সেখানে। ওম বিচ।”

ওম বিচের কথা শুনে মাথায় আলো জ্বলে উঠল আমার। কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি ওম বিচের কাছে তো কোন হোটেল, গেস্ট হাউস বা এরকম লজ-টজ নেই। তাহলে কি লক্ষ্মীবাবু ইচ্ছে করে বলেননি আমায়? সে কথা জানতে চাওয়ায় ছেলেটি দৃঢ়ভাবে জানালো, তাদের হোটেল গোয়া লিবারেশনেরও আগে থেকে চলছে। একেবারে ওম বিচের কাছে নয় ঠিকই, তবে খুব একটা দুরেও নয়। মাত্র তিন কিলোমিটার। এখান থেকে যেতে গেলে পাঁচ কিলোমিটার পড়বে তাদের হোটেল, পাহাড়ের ওপরে, জঙ্গলের কাছে। তাইজন্যই নাম নেচার স্টে। মনে মনে রাগ হল লক্ষ্মীবাবুর ওপর। এরকম একটা হেরিটেজ হোটেল এখানে থাকতে তিনি আমায় ঠেলছিলেন কি না তাঁর বন্ধুর ওয়েলকাম লজে? ভাগ্যিস এই ছেলেটা এখানে এসেছিল। একটু অবাক হলাম যদিও, কারণ ট্র্যাভেল গাইডবুক পড়া আমার অভ্যেস। গোকর্ণের ব্যাপারে যেকয়টি লেখা আমার চোখে পড়েছে, তাতে এই ‘ব্যাগপাইপার নেচার স্টে’ হোটেলের ব্যাপারে কোন লেখা আমি পাইনি। চোর-ডাকাতের খপ্পরে পড়ার ভয় তেমন আমার নেই। সাথে দামি জিনিস বলতে এই শখের ক্যামেরাটা, আর আমার মোবাইল। এ.টি.এম, ডেবিট কার্ডের যুগ হই হই করে চলছে তখন, সদ্য হোটেলে হোটেলে সরাসরি কার্ড পেমেন্ট করার চল হয়েছে। কাজেই আমি সামান্য কয়েকশ টাকা নগদ ছাড়া আর কিছুই কাছে রাখি না। স্টেট ব্যাঙ্কের কল্যাণে আর কিছু না হোক, একটা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ আর একটা এ.টি.এম নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা পেয়ে বসল আমাকে। বললাম, “চলো।”

ছেলেটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, “আপনি পাঁচ মিনিট বসুন, আমি বাইকটা নিয়ে আসছি।”, বলে দৌড়ে চলে গেল বন্ধ দোকানগুলোর পেছনের দিকে। বাঃ, বেশ ভালো ব্যাবস্থা দেখছি! হোটেলওয়ালারা বাইক দিয়ে পাঠিয়েছে? মনে মনে ভাবলাম, ভাগ্যিস আমি একা। একের বেশী লোকজন থাকলে কিভাবে যে সে নিয়ে যেত সকলকে, সেটা ভেবে পেলাম না। মনের সন্দেহ দূর হয়ে গেল ছেলেটার বাইকটা দেখে। এ হল সেই বাইক, যার পাশে নৌকোর মত একটা বসার গাড়ি জোতা থাকে। পুরনো মডেলের বাইক। সামনে আসতে অবাক হয়ে গেলাম। বাইকটা জাভা কোম্পানির। এ বাইক যে এখনও চলে বাজারে, তা আমার জানা ছিল না। ম্যানুয়াল গিয়ার, পুরনো তারের ব্রেক, এমনকি হেডলাইটা পর্যন্ত সেই মান্ধাতা আমলের বড় লোহার বাতি। দিব্যি দেখতে, মনে হয় রেগুলার গ্যারেজে ঝাড়পোঁছ করা জিনিস। কালো রঙের গায়ে নীল কালিতে লেখা ‘ব্যাগপাইপার নেচার স্টে’ নামখানা। সাথে একটা ব্যাগপাইপারওয়ালা বুড়োর ছবি। সত্যি, হোটেলওয়ালারা অভিনবত্ব বজায় রেখেছে বটে হেরিটেজ হোটেল চালাতে। চামড়ার ব্যাগ, চামড়ার বেল্ট, পুরনো চামড়ার হেলমেট, সবকিছুই যেন সেই ফেলে আসা ষাট-সত্তরের দশক থেকে তুলে আনা। কেবল দেখতে আনকোরা নতুনের মত। ছেলেটা আমার ব্যাগটা সেই চামড়ার বেল্ট দিয়ে বেঁধে ফেলল শক্ত করে পেছনের সিটে। আমি পাশের নৌকোগাড়িটায় বসতে বসতে বললাম, “তোমার নাম তো জানা হল না।”

“আমার নাম ডেভিড,” হাসিমুখে জবাব দেয় সে, “ডেভিড গঞ্জালেস।”



জঙ্গলের রাস্তায় বাইক চালিয়ে নিয়ে এসেছে ডেভিড। যাত্রা খুব একটা যে সুখকর হয়েছে তা নয়, কারণ রাস্তার অবস্থা তথৈবচ। জায়গায় জায়গায় খানা খন্দ, আগাছা বেরিয়ে এসেছে রাস্তার ওপর। মাঝে মাঝে যদিও হোটেলের বানানো মাইলফলক চোখে পড়েছে একটা-দুটো। কিমি নয়, এখানে মাইলে লেখা দুরত্ব। পাহাড় বেয়ে গোল হয়ে উঠতে উঠতে মাঝে মাঝে ওপরে দেখা যাচ্ছে একটা চার্চের মাথা। জিগ্যেস করে জেনেছিলাম আগেই, সেটা হোটেলের ভেতরেই একটা পুরনো গির্জার চুড়ো। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে পরিষ্কার দেখতে পেলাম গোকর্ণের সমুদ্রতট, মাঝে মাঝে পাথরের চাঁই। সমুদ্রতীরের রূপবর্ণনা করতে গেলে কোন ইংরেজি সিনেমা বা ডিসকভারি চ্যানেলের তথ্যচিত্রের সাহায্য নিতে হয়। এক কথায় অপূর্ব। ইতিমধ্যে মেঘ কেটে গিয়ে সামান্য সূর্যের আলো স্পটলাইটের মত এসে পড়েছে সমুদ্র ও বালির ওপর। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, বিধাতা বোধহয় টর্চ ফেলে দেখছেন, ঝড়জলের পর গোকর্ণের অবস্থা কেমন দাঁড়িয়েছে। মাঝে একজায়গায় ডেভিডকে দাঁড় করিয়ে কয়েকটা ছবি তুলেছি গাছপালার ফাঁক দিয়ে। অনবদ্য শট। ছবিগুলো ওয়াশ করা হলে যে লাখটাকার ছবি হবে, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই আমার। আসতে আসতে বেশকিছু কথা হয়েছে ডেভিডের সাথে। আসলে সে ও তার বাড়ির সকলে গোয়ার আদি নিবাসী। তার কোন পূর্বপুরুষ নাকি পর্তুগীজ সেনাদলে কাজ করতেন, এমনও শুনেছে সে। গোয়ার লিবারেশনের পর এই হোটেল সর্বসাধারণের জন্য খোলার পরেই তার পরিবার চলে আসে এখানে, সেই থেকে তারা এখানেই আছে। ডেভিডের মা মারিয়া হোটেলের মেইড এবং বাগানের পরিচারিকা। ডেভিড হল রান্নাঘরের হেল্পার এবং বাজার সরকার। বাসস্ট্যান্ড থেকে অতিথি আনা নেওয়া করার দায়িত্বও তারই।

যে চার্চের চুড়োটা চোখে পড়ছিল, সেটা স্থাপন করা হয়েছিল ১৯৩০-র মাঝামাঝি। হোটেলের ঘরগুলো তারপরে তোলা হয়। একসময় এই বাড়িটা ব্যাবহার করা হত পর্তুগীজ অফিসার এবং ‘এলিট’, অর্থাৎ ধনী পরিবারদের প্রমোদভবন হিসেবে। ইংরেজ সাহেবরাও কোন কোন সময়ে এখানে পদধূলি দিয়ে গিয়েছেন। শহরের দৌড়ঝাঁপ থেকে দূরে নিরালায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্যই এই ব্যাবস্থা। ১৯৬১তে গোয়া স্বাধীন হওয়ার পর এই হোটেল খুলে দেওয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। যত শুনছি ডেভিডের মুখে হোটেলের কথা, ততই অবাক হচ্ছি। আশ্চর্য! এমন একটা হোটেল যে রীতিমত দর্শনীয় স্থান হতে পারত এখানকার, আর সে ব্যাপারে কি না একটা ট্র্যাভেলগাইডেও লেখা নেই? ভারি রাগ হল মনে মনে গাইডবুকগুলোর ওপর। মনে মনে ঠিক করলাম, বেশকিছু ছবি তুলে ও শ্যুভেনির নিয়ে যাব যাওয়ার সময়, যাতে বন্ধুদের গল্প করে বলতে পারি এখানে থাকার ব্যাপারে।

প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর যে বাড়িটার সামনে এসে ডেভিড আমায় নামাল, সেটা একটা পুরনো আমলের পাথরের তৈরি ছোটখাটো সরাইখানা। একে ঠিক হোটেল বা লজ বলা যায় না। এতদিনে বুঝলাম, ইংরেজি গল্পের বইতে ‘Inn’ বস্তুটার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা বুঝি এরকমই। চারিদিকে পাঁচিল ঘেরা, জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে সময়ের সাথে। ওপরে জঙধরা বড় বড় শিক গাঁথা। মস্ত কালো রঙের লোহার গেটের পাশে দেওয়ালে একটা সাদা পাথরের ফলকে ইংরেজিতে লেখা ‘The Bagpiper’s Nature Stay, ESTD. 1932’। নিচে কোন ফাদার অমুকের নাম লেখা, যিনি চার্চের জমিসহ এই বাড়িটি দান করেছেন হোটেল বানানোর জন্য। ফাদারের নামটা ঠিক চোখে পড়ল না, একটা মস্ত শ্যাওলা জমেছে সমস্ত পাথরটা ঘিরে। গেট খুলে সহাস্যে যিনি আমাদের অভ্যর্থনা করলেন, তিনি অবশ্য ভারতীয়। দক্ষিণী কায়দায় সাদা ধুতি লুঙ্গির মত করে পরা ও সাদা হাফ শার্ট, মাথায় মস্ত কালো চুল পেছনে খোঁপা করে বাঁধা। বেঁটেখাটো এই কৃষ্ণকায় ভদ্রলোকটির নাম জানলাম থমাস বিজয়ন।

রিসেপশনে ফিরে এসে পরিচয় করায় আরও জানতে পারলাম, থমাস একজন কর্ণাটকবাসী ক্রিশ্চান। তিনিই এই হোটেলটির দেখরেখ করেন। এক কথায় রিসেপশনিস্ট, ম্যানেজার এবং যাকে বলে কেয়ারটেকার। একটা মস্ত জাবদা রেজিস্টার বই বের করে তিনি আমার নাম ধাম ইত্যাদি লিখে নিলেন। বইটার ওপর সাল লেখা ১৯৬৯।

বাড়িটা একতলা এবং মাথায় বেশী উঁচু না। পাথরের তিনকোনা ছাদের সাথে খাপ খাওয়ানো কাঠের থাম এবং কড়িকাঠ। রিসেপশনের পেছনে পাথরের দেওয়ালে টাঙানো অনেক সাদাকালো ছবি। কোনটা হোটেলের পার্টি হলের, কোনটা হোটেলের সামনে গেটের, একটায় দেখলাম চার্চের সামনে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। নিচে নিচে ইংরেজিতে সম্ভবত লেখা আছে সেগুলি কোন সময় এবং কি উপলক্ষে তোলা। সবকটি ছবি সাদাকালো, এবং দেখলেই বোঝা যায় বেশ পুরনো। একটাই মাত্র রঙিন ছবি, সেটা একটা তেলরঙে আঁকা একটি প্রৌঢ়ের, হাতে একটা মস্ত ব্যাগপাইপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর মুখটা ভালো দেখা যায়না। ভঙ্গিটা এমন, যেন মাথা নামিয়ে মন দিয়ে ব্যাগপাইপে ফুঁ দিচ্ছেন। চিত্রকরের নাম কোথাও নেই।

ছবিটার একটা নাম আছে যদিও। ‘The Spirit of the Bagpiper’।

একটা কাঠের নোটিস বোর্ড টাঙানো আছে, তাতে নানান দেশীয় কিছু পোস্টকার্ড পিন দিয়ে আটকান। বোধহয় হোটেলের অতিথিরা ফিরে যাওয়ার সময় বিভিন্ন শহরের কার্ড আটকে রেখে গেছেন। দেখতে দেখতে অনেকগুলো নাম চোখে পড়ল; বুয়েনস এরিস, টোকিও, নিউ ইয়র্ক, মস্কো, এমনকি বোম্বাইয়ের আর কোলকাতার নামের পুরনো কার্ডও চোখে পড়ল আমার। নিচে নিচে অতিথিদের নাম সই করা। কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিঙের সাদাকালো ছবি দেওয়া যে কার্ড দেখতে পেলাম, তাতে সালটা লেখা ১৯৫৫। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে কোন কার্ডই দেখলাম না ১৯৬৯-র পরের তারিখ দেওয়া। তাহলে কি এই হোটেলটা কোন থিম হোটেল নাকি? কিন্তু ১৯৬৯ তো কোন স্মরণীয় সাল নয়। স্কুলের ইতিহাসের খাতাগুলো মনে পড়ে গেল আমার, টায়েটুয়ে পাশ করতাম। নিশ্চয়ই কোন কারণে সালটা বাছা হয়েছে, আমিই জানি না।

থমাস নামধাম লেখা শেষ করে আমায় ডেকে বললেন, “আপনি থাকবেন রুম নম্বর ১২Aতে। সকালে ব্রেকফাস্টের সময় হল সকাল সাতটা থেকে নটা। লাঞ্চের অর্ডার নেওয়া হয় বেলা ১টা থেকে ২টো পর্যন্ত। বিকেলে চায়ের অর্ডার ৬টা থেকে ৭টা। ডিনারের অর্ডার নেওয়া হয় রাত ৯টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। বাধ্যতামূলকভাবে সমস্ত খানাপিনা হোটেলের হলে সারতে হবে। দিনের মেনু হলেই বোর্ডে লিখে দেওয়া হয় অর্ডার দেওয়ার সুবিধার্থে।” এতক্ষণ ধরে উশখুশ করছিলাম ফোনের ব্যাপারে জিগ্যেস করব বলে। থমাসের কথা শেষ হতেই জিগ্যেস করলাম, “ব্যঙ্গালোরে আমার একটা জরুরি ফোন করতে হবে, সে ব্যাবস্থা কি এখানে আছে?”

“ঝড়বৃষ্টির কারণে ট্রাঙ্ককল বুক করা যাচ্ছে না আপাতত। লাইন চালু হলেই আপনাকে জানিয়ে দেব, এখান থেকেই ফোন করতে পারবেন।”

‘ট্রাঙ্ককল’ কথাটা খট করে লাগল কানে। এই মোবাইলের যুগে আবার ট্রাঙ্ককল কি? এনারা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন না কি? অথচ হোটেল দেখে যে খুব একটা পুরনো বা অকেজো মনে হচ্ছে তা তো নয়। ডেস্কের কাছে এগিয়ে এসে উঁকি মেরে দেখলাম, একটি পুরনো রোটারি-ডায়াল টেলিফোন সেখানে রাখা আছে। সেটা অবশ্য খুব দুর্লভ বস্তু নয়, এখনও দোকানে পয়সা দিলে পাওয়া যায় বইকি। চাবি রাখার বোর্ডে ঝুলছে সার সার চাবি, দেখে বোঝা যায় বেশীরভাগ ঘরই ফাঁকা। জিগ্যেস করলাম, “আপনাদের কি এখন অনেক রুম ফাঁকা?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। আমাদের এখন গেস্ট তেমন নেই। তাই তো আপনাকে ১২A ঘরটা দিতে পারলাম। নাহলে ওটা আমাদের অন্য এক গেস্টের একেবারে বাঁধা ঘর। তিনি ওই সেপ্টেম্বরের শেষদিক করে প্রতি বছর আসেন। আসলে ওই ঘরটা থেকে ওম বিচ আর চার্চ, দুটোই দেখা যায়। আর পূবমুখো বলে সানরাইজও। আসুন…” বলতে বলতে একটা ট্রলি ঠেলে নিয়ে বেরলেন তিনি। আমার ব্যাগটা সেই খাটো ট্রলিতে চাপিয়ে নিয়ে চললেন করিডরের দিকে। দুদিকে দু'সার ঘর। ঘরের নম্বর ১০ থেকে ২০ পর্যন্ত যতদূর দেখতে পেলাম। করিডরের শেষ প্রান্তে হল। আমার কেমন অস্বস্তি হতে লাগলো এবার। হোটেলটা বড় বেশী নির্জন না? জঙ্গলের মধ্যে এই ফাঁকা সেকেলে একটা হোটেলে এসে শেষকালে বিপদে পড়ব না তো? মাথার দুপাশে দেওয়ালে টাঙানো সার সার ঝাড়লণ্ঠন, দেখলে মনে হয় যেন ইতিহাসের পাতা উল্টে ফিরে গেছি সেই কাউন্টদের আমলে। ভেতরে মোমবাতির খোপ করা আছে। অবশ্য এখানে যে বিজলি বাতির ব্যাবস্থা আছে তা আমার ঢুকেই চোখে পড়েছে। কিন্তু সুইচবোর্ড এবং প্লাগপয়েন্টগুলো পুরনো, সেই পোরসেলিনের ফিউজ বসানো।

ঘরের দরজাটা খুলে থমাস সহাস্যে আমার দিকে চেয়ে জিগ্যেস করলেন, “ঘর পছন্দ তো স্যার?”

খুব একটা বড় নয় ঘরটা। পাথরের মেঝে, পাথরের দেওয়াল। মেঝেতে কার্পেট পাতা। একটা মস্ত সেকেলে কাঠের আলমারি ও আয়না। একটি টেবিল এবং সোফা রাখা জানলার কাছে। একটি ডবল বেড, তাতে ইংরিজি কায়দায় মশারি টাঙানো চারিদিকে কাঠের ডাণ্ডায়। মশারি অবশ্য এখন গুটিয়ে ভাঁজ করে ওপরে তোলা। একপাশে মাথার কাছে একটি দড়ি ঝুলছে, বুঝলাম সেটি টানলেই ঝপ করে পর্দার মত মশারি চারিদিকে নেমে পড়বে। ধপধপে সাদা বিছানার চাদর এবং তুলোর বালিশ। সামনে দেওয়ালে মস্ত জানলার পাল্লাদুটো হাট করে খোলা। বাইরে চেয়ে সত্যি চোখ জুড়িয়ে গেল আমার। সামনে বাগানের কিছুটা অংশ। ওপারে চার্চ। চার্চের পাশ দিয়ে দেখা যাচ্ছে খোলা সমুদ্র আর ছবির মত ওম বিচ। চার্চের অবশ্য দরজা বন্ধ। থমাস জানালেন চার্চ রবিবার করে খোলা হয়, চাইলে আমি দেখতে যেতে পারি। হোটেলের স্টাফরা সেখানেই উপাসনা করতে যান। বাথরুমে উঁকি মেরে দেখলাম, ছোট হলেও বেশ গোছান। বিরাট আবক্ষ আয়নার সামনে একটা মস্ত স্টিলের বেসিন। একদিকে পর্দা টানিয়ে শাওয়ার বসানো স্নানের জায়গা ও কমোড। র‍্যাকে ঝুলছে পরিষ্কার করে কাচা সুগন্ধি তোয়ালে। শিশি ভরা শ্যম্পু ও বডিসোপ, তাতে হোটেলের নাম লেখা। এখানেও দেওয়ালে ঝুলছে সেই ব্যাগপাইপারধারী বুড়োর ছবি। একজনের থাকার জন্য এক কথায় অনবদ্য। থমাস একটুও বাড়িয়ে বলেন নি। এ ঘর সত্যি সেরা। এর চেয়ে অনেক খারাপ হোটেলে এবং অনেক কম জিনিসপত্র নিয়ে থেকে ঘুরে এসেছি আমি। তাই হেসে উত্তর দিলাম, “পছন্দ মানে? অসামান্য ঘরখানা।”

“ধন্যবাদ স্যার। এ ঘরের ভাড়া দিনপ্রতি একশ তিরিশ টাকা, খাওয়া এবং পানীয়ের খরচ আলাদা।”

বলে কি লোকটা! এই ঘরটার একদিনের ভাড়া একশ তিরিশ টাকা মাত্র? আমি মনে মনে প্রমাদ গুনছিলাম একরকম এই হোটেলে আদৌ থাকতে পারব কি না ভেবে, এ যে মেঘ না চাইতে জল! এ কি সরকারী গেস্ট হাউস না হোটেল মালিক উন্মাদ? আমি ঢোঁক গিলে বললাম, “তা বেশ তো। আপনারা কার্ড নেন তো?”

“কার্ড! কিসের কার্ড?” অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকেন থমাস।

“ডেবিট কার্ড?”

“ক্ষমা করবেন স্যার। আমরা শুধু ক্যাশ আর চেক নেই।”

এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। এতবড় হোটেলের নামমাত্র ভাড়া, ক্যাশ আর চেক নেয়, কেমন যেন আজগুবি থেকে আজগুবিতর হয়ে উঠছে সবকিছু। বাধ্য হয়ে বললাম, “দেখুন, আমার কাছে ক্যাশ বা চেক নেই। শুধু কার্ড আছে।”

“তা বেশ তো। যাওয়ার সময় ডেভিড আপনাকে বাজারে নামিয়ে দিয়ে আসবে। সেখানে ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আপনি ওকে বিল মিটিয়ে দেবেন। এরকম সমস্যা তো হতেই পারে স্যার। আমাদের এখানে কত দেশ-বিদেশ থেকে অতিথিরা আসেন, তাঁরা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেই বিল মিটিয়ে দেন।

Enjoy your stay”, বলে আর একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে থমাস টেবিলে ঘরের চাবি রেখে দরজা টেনে বেরিয়ে পড়েন।

আমি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়ে দি। মন থেকে অস্বস্তির ভাবটা কিছুতেই যেন যেতে চায়না। এই হোটেল, থমাস, ডেভিড, পোস্টকার্ড, সবই যেন কেমন খাপছাড়া। থমাস কি একটু বেশী বিনয়ী? তার কথাবার্তা, আদব-কায়দা কি বড় বেশী সেকেলে? ডেভিড কোনদিন মোবাইল দেখেনি, সেটা কি তার ভাণ না হোটেলের কোন নতুন চমক? বাড়িটা কি ইচ্ছে করে এমন পুরনো ধাঁচে বানানো হয়েছে? স্নান সেরে এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুম এসে গেল। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম, থমাস আমার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করছে, “সব ঠিক আছে তো স্যার?”

লোকটার যেন চোখে পলক পড়ে না।

লোকটা যেন হাঁটলে শব্দ হয় না।


চলবে



Comments


Subscribe Form

  • facebook
  • twitter
  • linkedin

©2020 by | Seek to See Beyond |. Proudly created with Wix.com

bottom of page